রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের দুর্নীতি – খবর সংগ্রহে ২ সাংবাদিক লাঞ্ছিত
সাগর চৌধুরীঃ রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার আমির হোসেন (৪৫) কর্তৃক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন দুইজন সাংবাদিক। গতকাল সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দুপুরে বালিয়াকান্দি উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস রুমে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা হলেন, দৈনিক বাংলা ৭১ ও অনলাইন বিবার্তা-২৪ এর রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধি মিঠুন গোস্বামী ও জাতীয় দৈনিক কালবেলা পত্রিকার বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রতিনিধি মো. রিয়াদ হোসেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, সাব-রেজিস্টারের কাছে অনৈতিক অর্থ লেনদেনের বিষয় জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, টাকা কি আপনার বাবার কাছ থেকে এনে দেয়। আপনি কোন ধরনের অভিযোগ করছেন। বের হন, আপনাকে ডেকেছে কে? বের হন, এখান থেকে। দুই কলম পড়ে এসে নাম লিখতে পারেন না, আসছে সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকদের অবস্থান এখন কই, ভালোই জানি। মাথা ঝুলাচ্ছেন কেন আপনি? মোবাইল দিয়ে কী রেকর্ড করেন? আপনি কার পারমিশন নিয়েছেন। এই মোবাইলটা নাও তো। এই দরজা আটকানতো। পিটাইয়া তারপর বের করতে হবে। এই মাসুদকে ডাক দেন তো।
লাঞ্চিত সংবাদকর্মী মিঠুন গোস্বামী বলেন, বালিয়াকান্দি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নানা অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ শেষে সাব-রেজিস্ট্রার কর্মকর্তার কাছে সাক্ষাৎকার চাইলে তিনি সাংবাদিকতা নিয়ে উপহাস করেন এবং আমিসহ আরেকজন সহকর্মীকে আটকে রেখে দরজা বন্ধ করে পেটাতে বলেন। যার ভিডিও রেকর্ড রয়েছে।
জানা গেছে, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি সাব রেজিস্টার অফিসের পরতে পরতে দুর্নীতি। ঘুষ ছাড়া কোনো একটি কাজ যেন স্বপ্নের সমান। দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকারি রাজস্বের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়। এছাড়া হায়ার ভ্যালু, হেবা ঘোষণাতেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি মোটা অঙ্কের টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে উচ্চমানের জমিকে নিম্নমানের উল্লেখ করে দলিল সম্পাদন করার। যার উদ্দেশ্য সরকারের বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া। জমির শ্রেণি পরিবর্তনে সরকারের বিশাল রাজস্ব ফাঁকি দিলেও সাব-রেজিস্টার ও সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এছাড়া রয়েছে কথিত সেরেস্তার নামে টাকা আদায় এবং পদে পদে হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্যের ম্যারাথন অভিযোগ।
জমি রেজিস্ট্রেশন করতে সরকারি ফি ইউনিয়ন পর্যায়ে ৬.৫ শতাংশ। কিন্তু বালিয়াকান্দি সাব রেজিস্টার অফিসে সরকারি নিয়ম চলে না! চলে দলিল লেখক সমিতির নিয়ম। এখানে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয় লাখে ১২ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার অব্দি। অঞ্চল এবং ব্যক্তি ভেদে এই অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়।
এসব অতিরিক্ত টাকা প্রতিটি দলিল লেখককে সরকারি ফিসের সঙ্গে হিসাব করে আলাদা বুঝিয়ে দিতে হয় সমিতির কাছে। এরপর আরও কয়েক হাত ঘুরে সেই টাকার একটা অংশ যায় রেজিস্ট্রারের হাতে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দলিল লেখক জানান, আমরা এখানে অসহায়, আমদের কিছু করার নাই। আমরা যদি দলিল প্রতি নির্ধারিত অতিরিক্ত টাকা হিসাব করে বুঝিয়ে না দেই তাহলে দলিলই গ্রহণ করবে না, সাইনতো দূরের কথা। তখন না খেয়ে মরতে হবে। তাই সব কিছু মেনে নিয়েই পেটের দুঃখে কাজ করে যাচ্ছি।
ভুক্তভোগীরা জানান, সাফ কবলা দলিল, হেবা ও দানপত্রসহ যেকোনো দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকারি ফির বাইরে দলিলদাতা ও গ্রহীতাকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়।
ঘুষের আদায়কৃত অর্থ সাব-রেজিস্ট্রার, তার কর্মচারী ও দালালদের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর নির্ধারিত হারে ভাগ করা হয়। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া কোনো একটি দলিল নিবন্ধন হয়েছে এমন উদাহরণ নেই বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তার এমন ব্যবহারে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সাংবাদিকরা সমাজের দর্পন। তাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করা উচিত ছিল। তা না করে এমন দুর্ব্যবহার সত্যিই অনৈতিক। আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।
রাজবাড়ী জেলা রেজিস্ট্রার সাজেদুর রহমান বলেন, আগামীকাল সাব-রেজিস্ট্রাদের সঙ্গে মিটিং আছে। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়টি উঠানো হবে।
এদিকে এ ঘটনায় সর্বশেষ সোমবার রাত সোয়া ৮টায় সাংবাদিক মিঠুন গোস্বামী বাদী হয়ে সাব-রেজিস্ট্রার আমির হোসেনের নাম উল্লেখ করে বালিয়াকান্দি থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
জানতে চাইলে, ঢাকা বিভাগের রেজিস্ট্রি অফিস সমূহের পরিদর্শক খন্দকার হুমায়ুন কবীর বলেন, আমার প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে কথা হয়েছে। জেলা রেজিস্ট্রার কে ঘটনা স্থল পরিদর্শন করে উভয় পক্ষের সাথে মতবিনিময় করে প্রচারিত ঘটনার প্রাইমাফেসি জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জানতে পারলাম, সে তদানুরূপ কাজ করছে। আপনি জানতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
আরও সংবাদ পড়ুন।
টাংগাইলের ভূঞাপুর সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ – দুদকের অভিযান
আরও সংবাদ পড়ুন।
নওগাঁ’র মহাদেবপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ দাবির অভিযোগে – দুদকের অভিযান
আরও সংবাদ পড়ুন।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী সাব-রেজিস্ট্রার ও কর্মচারীদের ঘুষ দাবির অভিযোগে – দুদকের অভিযান