রাজউক তো আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান
অপরাধ প্রতিবেদকঃ গণশুনানি ও অনলাইন সেবা ব্যবস্থা চালুর পরও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) ঘুষ লেনদেন বেড়েই চলছে। গত বছর ২৩ আগস্ট ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) গেজেট হওয়ার পর এ পর্যন্ত রাজউকের কাছে ভবনের নকশার আবেদন জমা পড়েছে ৭ হাজার ৫৪৯টি। এর মধ্যে ৬ হাজার ১৪৫টি নকশার অনুমোদন হয়। মাত্র ২৪টি অনুমোদন হয়নি।
গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতিটি নকশা অনুমোদনের জন্য কমবেশি ঘুষ দিতে হয়। সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে দুয়েকজন বোর্ড সদস্যও এই উৎকোচ নেন। নকশাপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষ ঘুষের পরিমাণ আরও বেশি।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, ‘বিভিন্ন সময় রিহ্যাবের পক্ষ থেকে ঘুষের বিষয়টি রাজউককে অবহিত করা হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি। কোনো আবাসন ব্যবসায়ী আলাদাভাবে এ অভিযোগ করতে চান না। তখন হয়তো তাঁকে নিয়েই খোঁচাখুঁচি শুরু হয়ে যাবে, এই ভয়ে। এমনকি অনলাইনে সেবা চালু হওয়ার পরও উৎকোচ বন্ধ হয়নি।’
এফবিসিসিআইর রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং কমিটির চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, এখন অনলাইন সার্ভারে নকশার আবেদন করতে হয়। প্রতিটি কাগজের কপি সংযুক্ত করে দিতে হয়। কিন্তু মিটিংয়ে তোলার পরই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল ধরা শুরু হয়। একের পর এক তথ্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর সমস্যা বেড়েছে। ১০ তলার একটি ভবন করতে হলে ১১টি সংস্থার ক্লিয়ারেন্স (ছাড়পত্র) আনতে হয়। বিমানবন্দরের আশপাশে হলে সিভিল এভিয়েশনেরও অনুমতি লাগে।
আগে শুধু আর্কিটেকচারাল-স্ট্রাকচারাল ডিজাইন দিলে হতো। এখন ফায়ার ডিজাইন, ইলেকট্রিক্যাল ডিজাইন, প্লাম্বিং ডিজাইন দেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছে। যত শর্ত বাড়ে, আবেদনকারীদের তত ভোগান্তি ও খরচ বাড়ে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজউক তো আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ওখানে একটি বড় সিন্ডিকেট আছে। পিয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। মানুষ অসৎ হলে প্রযুক্তি ব্যবহার করেও দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রাজউকের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনলে দুর্নীতি কমবে।
গত কয়েক দিন রাজউকের প্রধান কার্যালয় ঘুরে এবং বিভিন্ন সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে গ্রাহকের ভোগান্তি ও উৎকোচের নানা কাহিনি জানা গেছে। গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তার হওয়ার পরও রাজউক ঘিরে একটি বড় চক্র সক্রিয় আছে। রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা ও দালালের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে। মতিঝিল ও আশপাশের এলাকায় দালালদের রীতিমতো অফিসও রয়েছে। রাজউকের কয়েকজন কর্মচারীরও রয়েছে নিজস্ব কনসালট্যান্সি অফিস। সেবা নিতে গেলে অনেক কর্মকর্তা ওই সব অফিস দেখিয়ে দেন। তাঁদের মাধ্যমেই হয় ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, প্লট বিক্রির অনুমতি, নকশার অনুমোদনসহ বিভিন্ন কাজ। বড় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজউক সাইড দেখার জন্য একজন কর্মকর্তাই নিয়োগ করা আছে।
১/২২ দক্ষিণ কাজলার জাহাঙ্গীর খান জানান, ২০২১ সালের জুনে সাড়ে ৩ শতাংশ জায়গায় বাড়ি বানানোর উদ্যোগ নেন তিনি। রাজউকে যান ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য। আমিন নামের এক দালালকে ধরিয়ে দেন ৬ নম্বর জোনের উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ কামরুল হাসান সোহাগ। ৩০ হাজার টাকায় কাজ করে দেবেন বলে কথা হয়। টাকা দেওয়ার পর বলে রাস্তা চওড়া কম। গুগল ম্যাপে ধরা পড়ে যাবে। এ জন্য আরও ৩০ হাজার দিতে হবে। এর পর সার্ভেয়ার যাওয়া শুরু করেন। তাঁকেও খুশি করতে হয়। পরে কানুনগো রহমানের কাছে ফাইল যায়। রনি নামের এক অস্থায়ী সার্ভেয়ারকে পাঠান তিনি। তাঁর রিপোর্টের পর বোর্ডে ওঠে। এর পরই রাজউকের সার্ভার হ্যাক হয়ে যায়। তখন সব কাগজপত্র হারিয়ে যায়। নতুন করে ড্যাপে আবেদন করতে বলা হয়। তখন মোবাইলে মেসেজ আসে ‘আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে’। আবার আবেদন করে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে গত ২৪ মে তিনি ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র পান। জাহাঙ্গীর খান বলেন, রাজউকে ঘুরতে ঘুরতে আর ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে দিতে তাঁর বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডেভেলপার বলেন, কিছু ইন্সপেক্টর ভবনের ডেভিয়েশন করতে উৎসাহিত করেন। কারণ ভবনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ‘ডিম’ নেওয়া যাবে। পরে আবার অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য অথরাইজড অফিসাররা ডেভিয়েশনের অভিযোগ তোলেন। তখন তাঁকেও খুশি করতে হয়। জোন-৪ এর একজন অথরাইজ অফিসারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছিল।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো নকশা অনুমোদন করতে গেলে ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয় গ্রাহককে। সবচেয়ে বেশি হয়রানি হতে হয় ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য। প্রথমেই সার্ভেয়ারকে খুশি করতে হয়। এর পর সহকারী নগর পরিকল্পনাবিদ, ইন্সপেক্টর, চিফ ইন্সপেক্টর, সহকারী অথরাইজড অফিসার, অথরাইজড অফিসার– এসব পদের দু-একজন সৎ ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবাইকেই খুশি করতে হয়। প্রকারভেদে প্রতি নকশা ৫০ হাজার টাকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে তলাভেদে টাকা দিতে হয়। টাকা নেওয়ার জন্য ‘এটা ঠিক নেই, ওটা ঠিক নেই’ বলে তাঁরা হয়রানি করতে থাকেন। কখনও কখনও দু-একজন বোর্ড সদস্যকেও খুশি করতে হয়।
বছরে ঘুষের পরিমাণ শত শত কোটি টাকা
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার নকশার অনুমোদন দেয় রাজউক। প্রতিটিতে ঘুষের পরিমাণ ২ লাখ টাকা হিসাব করলেও নকশা অনুমোদন খাতে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড়শ কোটি টাকার ওপরে। এ ছাড়া প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রির অনুমতিতেও অনেক সময় বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। গুলশান-বনানীর মতো এলাকায় একটি প্লটের সেল পারমিশনে লাগে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা।
কাগজপত্রের ঘাটতি থাকলে পরিমাণ আরও বাড়ে।
ফজলুর রহমান পাইকার নামের এক ব্যক্তি জানান, ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে পূর্বাচলে তিনি একটি প্লট পেয়েছিলেন। টাকা-পয়সা পরিশোধ করে রেজিস্ট্রি করে সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার পর রাজউক থেকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, তাঁর প্লট নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। পরে দেখতে পান, পরিবর্তন করে তাঁকে যে প্লট দেওয়া হয়েছে, সেটা আরেকজনের নামে বরাদ্দ। তাঁরটাও অন্য কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এক বছর টেবিলে টেবিলে ঘোরার পর রাজউক তাঁর আগের প্লটই বহাল রাখে। ওয়েবসাইটেও তাঁর নাম ওঠে। এসব করতে গিয়ে খরচ করতে হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। এখন আবার সার্ভেয়ার নতুন করে বুঝে নেওয়ার কথা বলছেন কেন বুঝতে পারছেন না।
লিখিত অভিযোগ করতে চান না কেউ
রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে উৎকোচ বাণিজ্য ও ভোগান্তি কমাতে বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতি মাসের প্রথম ও তৃতীয় সোমবার সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী গণশুনানির আয়োজন করা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে গণশুনানিতে হাজিরার উপস্থিতি কমতে থাকে। পরবর্তী সময় অনলাইনেও সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় গণশুনানিও প্রায় অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। রাজউক বোর্ডের পরিচালক শামিমা মোমেন বলেন, অভিযোগ না থাকলে গণশুনানি করা হয় না। এই বিষয়ে সাংবাদিকদেরও জানানো হয় না।
রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, আমি চাই গণশুনানির দিন ভুক্তভোগী তাঁর সমস্যার কথা উপস্থাপন করুক। কিন্তু গণশুনানির সময় লোকজন পাওয়া যায় না। কিছু লোক আছেন, তাঁরা গণশুনানিতে না গিয়ে দালাল খুঁজতে থাকেন। আবার গণশুনানির সময় কিছু না বলে আমার রুমে চলে আসেন। আমি চাই, প্রকাশ্যেই সমস্যাগুলোর সমাধান হোক।
কর্মচারীদের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, আমার কাছে এ রকম অভিযোগ কেউ করেন না। কেউ যদি গ্রহণযোগ্য অভিযোগ করেন, তাহলে সেই মুহূর্তেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও সংবাদ পড়ুন।
রাজউক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী দেবাশীষ বরখাস্ত, বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত রাজউকের
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
হাইকোর্ট – রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চান