নজিরবিহীন লুটপাট ও অলীক কল্পনার অবাস্তবায়নযোগ্য গণবিরোধী বাজেট – মির্জা ফখরুল ইসলাম

Picsart_23-06-07_13-16-15-368.jpg

নজিরবিহীন লুটপাট ও অলীক কল্পনার অবাস্তবায়নযোগ্য গণবিরোধী বাজেট – মির্জা ফখরুল ইসলাম

বিএনপি’র বাজেট প্রতিক্রিয়া
অর্থবছর ২০২৩-২৪

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,আসসালামু আলাইকুম,
সরকার গত ০১ জুন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে তা বর্তমান ফ্যাসিস্ট লুটেরা সরকারের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার এক বার্ষিক ঘোষণাপত্র মাত্র। এই বাজেট কল্পনাবিলাসী বাস্তবায়ন অযোগ্য এক উচ্চাভিলাষী বাজেট। এটা স্রেফ দুর্নীতিবাজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটের লক্ষ্যে প্রণীত “অর্থ লুটেরাদের বাজেট”। বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে যাওয়া, বেপরোয়া অর্থপাচার, জনগণের কাঁধে রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা একেবারের জন্যেও স্বীকার করা হয়নি। পরিত্রাণের উপায়ও বলা হয়নি। তেমনিভাবে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচার এর ধারণাকে।
এই বাজেট পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩.৪% এবং উন্ন্য়ন ব্যয় ৩৬.৪%। বাজেটের এই অর্থের সংস্থান হবে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আয় থেকে, আর ঘাটতি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ঋনের মাধ্যমে। রাজস্ব আয়ের ৩২.৮% পরোক্ষ কর (ভ্যাট) এবং ৩০.৭% প্রত্যক্ষ কর। এরই সাথে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৫% এবং মুদ্রাস্ফীতির হার ৬% প্রত্যাশা করছে! এ বাজেট বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো বাজেট, জনকল্যাণের নয়।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগসহ সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে তা অর্জনযোগ্য নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৫% লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও তা কিভাবে অর্জন করা হবে তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। চলতি অর্থবছরেও ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৫%। সংশোধনী বাজেটে তা পরে ৬.৩% পুনঃনির্ধারণ করা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন এবারও ৭.৫% টার্গেট অর্জন সম্ভব হবে না। কেননা অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে।

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
মূল্যস্ফীতি: বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। এ চাপ মোকাবেলায় বাজেটে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিদ্যুৎ, জ¦ালানি, পরিবহন এবং খাদ্যসহ তেল, চাল, আদা, চিনি, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক আগেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিবিএস এর সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৯৪%, যা গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ। বাস্তবে যা ১৮-২০% এর উপরে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অর্থমন্ত্রী বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরাও শংকিত। সারা বিশে^ এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারব না। একটি নমনীয় পথে এগুচ্ছি ……।” তার কথাটি সঠিক নয়। বাস্তবতা হচ্ছে চীন, আমেরিকা, ভারতসহ বিশে^র নানা দেশে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিশেষভাবে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। [রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) চলতি সপ্তাহের তথ্যানুযায়ী, ভারতে বার্ষিক খুচরা বাজারের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ (সূত্রঃ সময় নিউজ, ১৫ ফেব্রæয়ারি ২০২৩)]। অর্থমন্ত্রী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোন পথরেখা না দিয়েই কিভাবে মূল্যস্ফীতি টার্গেট ৬% ঘোষণা করেছে তা বোধগম্য নয়। বাজেটে একদিকে বিনিয়োগ ২৭.৪% এ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। অপরদিকে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ১ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ অংকের ঋণ যদি সরকার নিজেই নিয়েই নেয়, তবে বেসরকারি খাত নিঃসন্দেহে ঋণপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তাহলে বিনিয়োগ আসবে কোত্থেকে ? এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কিভাবে ২৭.৪% এ উত্তীর্ণ হবে তার কোনো নির্দেশনা দেয়নি অর্থমন্ত্রী।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আপনারা জানেন, দেশের অর্থনীতি মহাবিপর্যয়ে রয়েছে। ডলারের সংকট প্রকট। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গেলে প্রায় সকল ব্যাংক ফিরিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। সরকারি হিসাব মতে গত ৭ বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। আইএমএফ এর হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। বিশ্বস্ত সূত্র মতে, ইতিমধ্যে নতুন নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার উপর। একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থ পাচার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। জিএফআই বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪,৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। সিআইডি বলছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য মিলে প্রতিবছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশে চারিদিকে শুধু হাহাকার। তবে এই হাহাকার সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ও সুবিধাভোগী নব্য ধনীদের জন্য নয়। সরকার প্রতিষ্ঠিত ড়ষরমধৎপয রা সম্মিলিতভাবে সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে দিব্যি ভালো আছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তারা দেদারসে অর্থ লোপাট করছে। ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে। আর অন্যদিকে গরিব আরও গরীব হচ্ছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, করোনা উত্তরকালে প্রায় চার কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বর্তমানে ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। রাষ্ট্রযন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সরকার নিজস্ব একটি অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করেছে- যা বলা যায় “জবহঃ ঝববশরহম” এর অর্থনীতি, ঊীঃৎধপঃরাব অর্থনীতি এবং ঢ়ধঃৎড়হ-পষরবহঃ ৎবষধঃরড়হ এর অর্থনীতি। যা টেকসই উন্নয়নের ধারণার পরিপন্থী।

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক ব্যবস্থায় নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। ব্যাংকের অতিরিক্ত ক্যাশ লিকিউডিটি কমেছে ৫৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা (ঘবি অমব: ২৪-১-২৩)। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। তবে পুনঃ তফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। গত বছরের প্রথম নয় মাসেই খেলাপি বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত ৩ মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১০০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
এমনিতেই গত ৬ বছরে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এক্ষণে চীন ও রাশিয়া থেকে নেয়া কঠিন শর্তের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২০২৪ সন থেকেই বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের বোঝা ছিল ৩২৪ মার্কিন ডলার, টাকার অংকে যা প্রায় ৩২ হাজার ৭৪০ টাকা (প্রতি ডলার ১০১ টাকা দরে)। বর্তমানে আরও বেড়েছে। আইএমএফ চাচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে ১০ শতাংশ এর নিচে ও বেসরকারি ব্যাংক গুলোতে ৫ শতাংশ এর নিচে থাকুক খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কিন্তু বর্তমানে কৌশলে এক ব্যাংকের আদায়যোগ্য খেলাপি ঋণ আরেক ব্যাংকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
দেশের এই চরম অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে প্রয়োজন ছিল দল, মত ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি সাহসি ও বাস্তবসম্মত বাজেট। কিন্তুু মোটাদাগে এ বাজেট আইএমএফ এর শর্ত বাস্তবায়ন এবং বিগত অর্থবছরের বাজেটের ১৪-১৫% বর্ধিত অবস্থা ছাড়া কিছুই না। অথচ আইএমএফ এর সঙ্গে ঋণচুক্তির কথা উল্লেখই করেননি অর্থমন্ত্রী। এদিকে আইএমএফ এর শর্তপূরণে বাড়তি আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড় কমানোর বড় উদ্যোগ বাজেটে নেই।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
কর্মসংস্থান: বাজেটে আয় বৃদ্ধির জন্য কর্মসংস্থানের বিশেষ কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়নি। আর কর্মসংস্থান না হলে মানুষের আয় বাড়বে না। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা তারা সামলাবে কিভাবে ?

মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে: আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। মুডিস বলেছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশে ডলার-সংকট চলমান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাচ্ছে, যা এ দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। সেই সঙ্গে আমদানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে। যার ফলাফল হিসেবে জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।এ কারণে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে দিয়েছে (বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়েছে)। এর ফলে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ ও ঋণের সুদের হার বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা (প্রথম আলোঃ ৩১ মে, ২০২৩)।

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
সরকার ইতোপুর্বে করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদেরও ৪৪ ধরনের সেবা গ্রহণে ঞওঘ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে যা মধ্যবিত্তের উপর জুলুম। প্রশ্ন হলো যার আয় কম তিনি কি ঐ সকল রাষ্ট্রীয় সেবা পাবেন না! একদিকে ন্যূনতম আয়কর সীমা বাড়িয়ে ৩,৫০,০০০ টাকা প্রস্তাব করেছে, অপরদিকে আয় না থাকলেও মিনিমাম ২০০০ টাকা আয়কর ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে যা সাংঘর্ষিক, ন্যায়নীতি বর্জিত এবং ‘আয়ের উপর কর’ নীতিরও পরিপন্থী।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
একদিকে মধ্যবিত্তের ওপর ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, অন্যদিকে চার কোটি টাকা পর্যন্ত মোট সম্পদের ওপর কোনো সারচার্জ দিতে হবে না। এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লক্ষ কোটি টাকার উপরে লুট করেছে তারা। বাড়তি বিদ্যুৎ ভর্তুকি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪০% শতাংশ বেশি। অনেকে বিশ্বাস করেন বিদ্যুৎখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দের মূল কারণ ক্যাপাসিটি চার্জ ও কুইক রেন্টালের নামে অর্থ লোপাটের আরও সুযোগ করে দেয়া। অথচ সারাদেশে মারাত্মক লোডশেডিং চলছেই। গ্রামে তো বিদ্যুৎ বলতে গেলে থাকেই না। রাজধানীতেই বিদ্যুৎ লোডশেডিং এ সকলের ত্রাহি অবস্থা। অথচ উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ফেরী করে বিক্রি করতে হবে পার্লামেন্টে অহমিকা করেছে সরকার। এদিকে ডলারের অভাবে কয়লা কিনতে না পারায় পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়ের জন্য প্রধানতঃ দায়ী এই অবৈধ সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি। সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানী আবিষ্কার ও উত্তোলনে কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বোধগম্য কারণে আমদানি নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
শেয়ার বাজার: প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ার বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারীর জন্য কোন আশার আলো নেই। শেয়ার বাজারে সর্বস্বান্ত হাজার হাজার মানুষের আহাজারি সরকারের কানে পৌছে না। এ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শেয়ার বাজারের সংকট দূর হবে বলে কেউ বিশ্বাসও করে না। শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের উপরে গঠিত তদন্ত রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি।
সামাজিক নিরাপত্তা: বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাজেট ও জিডিপির অনুপাতে এ খাতে বরাদ্দ কমেছে। বরাদ্দ বেশি দেখানোর কৌশল হিসেবে এই খাতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়, যা বাস্তবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই নয়। এছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেওয়া প্রণোদনার টাকাকেও সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা এবং প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভাতা বৃদ্ধির দাবীতে স¤প্রতি প্রতিবন্ধীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আয়-বৈষম্য: প্রস্তাবিত বাজেটে আয়-বৈষম্য নিরোধের কৌশল সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। উপরন্তু পক্ষপাতমূলক নীতিকাঠামো আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়াচ্ছে। গত ১২ বছর ধরে দেশের গিনি সহগ ঊর্ধ্বমুখী যা ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯ এ পৌঁছেছে।
কর আরোপে বৈষম্য: দেশে যখন ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে, এই বাজেটে প্রস্তাবিত করনীতি তা আরও কয়েকগুন বাড়াবে। এছাড়াও সরকার গরিব মানুষের জন্য বোঝা-ভ্যাট থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৬৩,৮৩৭ কোটি টাকা যা মোট আয়ের ৩২.৫%, যেখানে প্রত্যক্ষ কর থেকে আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ১৫৩,২৬০ কোটি টাকা বা ৩০.৪%। পরোক্ষ করের বোঝা যে ন্যূনতম আয়ের মানুষেকেও ব্যয় করতে হয় সেটা জেনেশুনেই গণবিরোধী সরকার এ কাজটি করেছে। সরকার শিক্ষার কথা বলে অথচ দাম বাড়ায় কলমের, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে অথচ দাম বাড়ায় ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের, গরিবের কথা বলে অথচ পরোক্ষ কর আরোপ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উপর। এটি স্পষ্টতই জনগণের সাথে প্রতারণা। এই বাজেটে সাধারণ ও দরিদ্র জনগণের জন্য কোন সুখবর নেই।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি: স্বাস্থ্যখাতে মোট বাজেটের ৫% শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল বাজেটের ৫.৪% শতাংশ, অর্থাৎ ০.৪% কমানো হয়েছে। এদিকে জিডিপির শতকরা হারেও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ০.৮৩% হতে ০.৭৬% এ হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষাখাতেও মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ ছিল জিডিপির শতকরা হারে ২.২৫%। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ হ্রাস পেয়ে জিডিপির শতকরা হারে ২.০৮% এ দাঁড়িয়েছে। এদেশে এই প্রথম শিক্ষা উপকরণ কলমের উপর ১৫% ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যা শিক্ষা সংকোচন নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। কৃষি খাতে আগামী অর্থবছরে টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এই খাতে বরাদ্দ শতকরা ০.৩৩% কমেছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
মোট রাজস্ব প্রাপ্তি: এ বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থায়ন বা রাজস্বপ্রাপ্তি। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে টার্গেট ৫ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি বছরে প্রথম ১০ মাসে এনবিআর তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া সত্তে¡ও আগামী অর্থবছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৪ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। অর্থাৎ প্রক্ষেপণকৃত আয় মূলত একটি কাগুজে গোঁজামিল ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাজেট ঘাটতি: বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২,৫৭,৮৮৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এবং জিডিপি’র ৫.২ শতাংশের মোট। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর যে আয়োজন অর্থমন্ত্রী করেছেন, তাতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। যদিও বাজেট ঘাটতি অর্থনীতিতে নতুন কিছু নয়, ক্রমবর্ধমান এই ঘাটতির ফলে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশের মোট ঋন দাড়িয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকায়। অর্থ্যাৎ বর্তমান বাজেটের আয়ের প্রায় ৪ গুন। সুতরাং এই ঘাটতি বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ঝুকিসীমার উপরে থাকা ঋনকে আরও বৃদ্ধি করবে এবং দেশের বর্তমান ম্রিয়মাণ অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলে দিবে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের বোঝা: এ বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৪,৩৭৬ কোটি টাকা কেবলমাত্র ঋণের বর্ধিত সুদ পরিশোধে। তন্মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৮২,০০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবত ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। ঋণ করে ঘি খাওয়া কাকে বলে!
বাজেট বাস্তবায়নের অসম্ভাব্যতা: ২০২৩-২০২৪ সালে সরকার রাজস্ব টার্গেট করেছে ৫০৩,৯০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের তুলনায় ১৫.৫% বেশি। এনবিআর’র পক্ষে এই রাজস্ব সংগ্রহ অসম্ভব। এক বছর আগেও যেখানে রাজস্ব আয় ছিল ৩৫০,০০০ কোটি টাকারও কম, সেখানে এবার এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৪৩০,০০০ কোটি টাকা। এটা যে আদায় করা অসম্ভব- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এই বাজেট কল্পনাবিলাসী ও বাস্তবায়ন অযোগ্য। বর্তমান অর্থবছরে প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৪৫% এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। জোড়াতালি দিয়ে হয়তো আরো কিছুটা বাড়ানো যাবে। তবে পরবর্তী অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন যে আরও কঠিন হবে তা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বিশ^বাজারে জ¦ালানির দাম প্রতি ব্যারেলে কমে ৭০-৭৫ ডলারে নেমেছে। অথচ বাংলাদেশে দাম কমানো হলো না।

বাজেটে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ক্ষমতার বলয়ের বাহিরে সাধারণ মানুষের অনুকূলে এ বাজেট কোনো ভূমিকা রাখবে না। এ বাজেট গণবিরোধী বাজেট। গত এক দশকে গোষ্ঠীস্বার্থে পলিসি ইস্যুজ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রাজস্ব সেক্টর বা আর্থিক খাতসহ অন্যান্য জরুরি খাতে কাঠামোগত বড় কোনো সংস্কার করা হয়নি। এই বাজেটেও এসকল সংস্কারের কোন ইঙ্গিত নেই।

স্মার্ট বাংলাদেশে এবার তারা স্মার্ট লুটপাটের বাজেট দিয়েছে। তারা চুরিতে স্মার্ট। ভোট চুরি, ব্যাংক চুরি, অর্থপাচার এসব কিছুতেই। স্মার্টলি লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি করার, ব্যাংক লুটপাট, সিন্ডিকেট পরিচালনা, জনগণের সম্পদ লুটের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে এ বাজেটে। এদেরকে লুটপাটের অংশীদার বানানো হয়েছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশের প্রধান জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে সরকারের জাবাবদিহিতা থাকেনা; দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই জাতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধমূলক নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটার একমাত্র পথ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান।

আরও সংবাদ পড়ুন।

পিটার হাসের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক

আরও সংবাদ পড়ুন।

বিএনপির তিন সংগঠন তারুণ্যের সমাবেশ করবে ৬ বিভাগীয় শহরে

আরও সংবাদ পড়ুন।

‘সেইফ এক্সিট’ চাইলে তত্ত্বাবধায়কের হাতে ক্ষমতা দিন – সরকারকে ফখরুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top