স্বাস্থ্য বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ – দেশের স্বার্থ নয় দলীয় স্বার্থে হচ্ছে নিয়োগ
বিশেষ প্রতিবেদকঃ স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চলছেই, খুড়িয়ে চলা গরুর গাড়ির মতন। এ নিয়োগ পেয়ে অনেকে গত ৯ বছর ধরে ইচ্ছেমতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। আবার সরকারি চাকরি বিধিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিষিদ্ধ হলেও অনেকে বিধি লঙ্ঘন করে ক্ষমতাসীন দলের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে একাধিক চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক তদবিরের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। বছরের পর বছর এমন কর্মকাণ্ড যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হতে বসেছে।
বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমে বলেন, অধিদপ্তর ও হাসপাতালের পদগুলোয় দায়িত্ব পালনের মতো একাধিক যোগ্য ব্যক্তি থাকলেও এবং সবকিছু জেনেও নীতিনির্ধারকরা রহস্যজনক কারণে চুপ থাকছেন। এতে করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিভাগে নয় বছরে নয়জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল গণমাধ্যমে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান আছে। আবার দপ্তরগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিও আছে। শীর্ষপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে অগ্রাধিকার প্রাপ্তদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এর প্রভাব দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডেও পড়তে পারে। এতে পদসোপান ধারাও ব্যাহত হয়। যোগ্যরা নিচ থেকে উপরে উঠতে না পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবে না। মূলত সরকারি আইন ও ধারাগুলো ঠিকমতো অনুসরণ না করায় এমনটা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী-ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয় ২০১৪ সালের ১০ জানুয়ারি। পরদিন থেকে তার ‘পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ’ (পিআরএল) বা অবসরোত্তর ছুটি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক পরিচালক পদে নিয়োগ পান। এরপর দুই ও তিন বছর করে বাড়িয়ে একই চেয়ারে তিনি আসীন রয়েছেন।
৯ বছর বছর ধরে তিনি চুক্তিভিত্তিক পরিচালক হিসাবে কর্মরত আছেন। হাসপাতালটির চিকিৎসকরা গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ এর ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা কোনো প্রকার সহায়তা করতে পারবেন না।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’-এর ২০২১ সালের ২৮ জুন জারি করা প্রজ্ঞাপনের (চ) ধারায় বলা হয়েছে-সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর তিন বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো ধরনের নির্বাচন বা রাজনৈতিক দলের সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না। (জ) ধারা অনুযায়ী কেউ সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরপরই অনুরূপ চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেই মেয়াদ অতিক্রান্ত বা বাতিল হওয়ার পর তিন বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
কিন্তু গত বছর ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে সংগঠনের জাতীয় কমিটির সদস্য হিসাবে অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ যোগ দেন।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সূত্র গণমাধ্যমে জানায়, কাজী দীন মোহাম্মদ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নন। তাকে কেন্দ্র থেকে জাতীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়েছে এবং জাতীয় কমিটির সদস্য হিসাবে তিনি ওই সম্মেলনে যোগ দেন। এ ব্যাপারে জানতে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে একাধিকার গিয়েও ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ তিনি সেই পদও দখল করে রাখেন। ফলে মন্ত্রণালয় চাইলেও ওই পদে অন্য কাউকে পদোন্নতি দিতে পারে না। যেমন অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের কারণে নিউরো মেডিসিন অধ্যাপক পদে এক দশক ধরে কাউকে পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতিবছর নিউরোসার্জারি ও নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি হচ্ছে।
অনেক সিনিয়র চিকিৎসক অধ্যাপক হয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু অনেকেরই স্বপ্ন থাকে হাসপাতালটির শীর্ষপদে যাওয়ার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফার বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয় ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল। এর পরদিন থেকে তার পিআরএল শুরু হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে তিনি ছয় বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ আসনে বসে আছেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মকসুদুল হকের ২০২০ সালের ২৪ জানুয়ারি পিআরএল শুরু হওয়ার কথা। সাড়ে তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।
এছাড়া জাতীয় অর্থোপেডিকস ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গণি মোল্লা দুই বছর করে পরপর দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে পাঁচ বছর শেষ করেছেন। এখনো তিনি ওই পদে বহাল। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের পিআরএল শুরু হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল থেকে। একই পদে তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের হিড়িকঃ অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম ২০২০ সালের নভেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়োগ পান। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার পিআরএল শুরু হওয়ার কথা। মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগের আগে তার চাকরির বয়স ছিল এক মাসের মতো। তাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শেষ কার্যদিবস ছিল গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর। পদটি ৩০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত শূন্য ছিল।
১০ জানুয়ারি ডা. আবুল বাশারকে আবারও দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিতে মহাপরিচালক পদে বসানো হয়। ডা. খুরশীদ আলমের আগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের পিআরএল শুরুর তারিখ ছিল ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল। তিনিও দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তবে করোনাভাইরাসকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগে তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য হন। মামলায় তিনি নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক হিসাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মাদ নূরুল হক।
২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তার চাকরির বয়স শেষ হয়। এর দেড় মাস আগেই তিনি এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগ পান। এক বছর পার হওয়ার পর তাকে আরেকবার নিয়োগ দেওয়া হয়।
মতামত জানিয়েছেন বিশিষ্টজন ড. ইফতেখারুজ্জামান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ শুধু অপরিহার্য ক্ষেত্রে একান্তই ব্যতিক্রমী ঘটনা হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তা এখন নিত্যনৈমিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে প্রাক-অবসরকালীন অসুস্থ প্রতিযোগিতা, গ্রুপিং তৈরি হয়।
পেশাগত দক্ষতা-বহির্ভূত রাজনৈতিক ও অন্য প্রভাবের প্রাধান্য-নির্ভর যোগসাজশ ও লবিংসহ বিভিন্ন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে সরকারি খাতে কর্মসম্পাদনে দক্ষতা ও উৎকর্ষের অবক্ষয় হয়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বলে জবাবদিহিতাহীন অনৈতিকতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিধিবহির্ভূত আচরণের বিস্তার ঘটে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এ কারণে অনেকে ভাবছেন সাফল্যের চাবিকাঠি হিসাবে পেশাগত উৎকর্ষের কোনো মূল্য নেই। বরং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব বা অনুরূপ অন্য কোনো মাপকাঠি সাফল্যের পাথেয়। যা পাবলিক সার্ভিসের জন্য অশনিসংকেত।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহ. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গণমাধ্যমে বলেন, ঢাকার বাইরে (কক্সবাজার) মিটিংয়ে আছেন। ঢাকায় ফিরে তিনি কথা বলবেন। পরে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
আরও সংবাদ পড়ুন।
সারাদেশে অবৈধ এক লাখ ফার্মেসি বন্ধ করা হবে – ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
আরও সংবাদ পড়ুন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে সাড়ে চার কোটি টাকার ক্রয়ের অনিয়ম – দুদকের অভিযান