দারুস সালাম ওসির কাণ্ড! নারীর অভিযোগ
অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো আসামি নারী।
শেষ কর্মদিবসে দারুস সালাম ওসির কাণ্ড!
ভিত্তিহীন দাবি ওসির।
অপরাধ প্রতিবেদকঃ রাজধানীর দারুসসালাম থানায় ২০১৯ সাল থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব পালন করেছেন মো. তোফায়েল আহমেদ। বদলিজনিত কারণে গত শুক্রবার ওই থানায় ছিল তার শেষ কর্মদিবস। কিন্তু বদলির শেষদিনেও অঘটন সৃষ্টি করেছেন ওসি তোফায়েল।
অভিযোগ উঠেছে, একই থানাধীন হরিরামপুর এলাকায় উম্মে সালমা চৌধুরী রানু নামের এক গৃহবধূর প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের জমি জবরদখলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মরিয়া গিয়াসউদ্দিন নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।
বাড়ি দখলকে কেন্দ্র করে একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন সালমা চৌধুরী। এ ঘটনায় ওই নেতা ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী।
গত শুক্রবার দুপুরে সালমার ওপর হামলা করা হয়। এরপর তিনি জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর সহায়তা চাইলে বাসায় যান দারুসসালাম থানার পুলিশ। সবকিছু দেখে থানার এসআই মো. রেজাউল করিম তাকে পুনরায় হামলার শিকার হবেন না বলেও তাকে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু থানায় গিয়ে ভোল পাল্টে ফেলেন এসআই। বাড়ির কাগজপত্র দেখার নাম করে বিকাল ৪টার দিকে ওই গৃহবধূ ও তার স্বামীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে থানায় ডেকে নেন তিনি। এরপর রাত ১১টা পর্যন্ত ওই দম্পতিকে বসিয়ে রাখা হয় পুলিশ প্রহরায়।
একপর্যায়ে তাদের ডেকে নেওয়া হয় ওসির কক্ষে। সেখানে সদলবলে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা। রাত আড়াইটা পর্যন্ত গৃহবধূ সালমাকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নিজ কক্ষে বসিয়ে বিভিন্ন হুমকিধমকি দেন ওসি তোফায়েল; বেপরোয়া ছিলেন দারুসসালাম থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি গিয়াসউদ্দিনও। রাজি না হওয়ায় ওই আওয়ামী লীগ নেতা ও ওসির করসাজিতে অভিযোগ দায়ের করা হয়। পরে ওই গৃহবধূকে গ্রেপ্তার করেন ওসি।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ, থানায় পুরো রাত খাবার-পানি কিছুই দেওয়া হয়নি ওই নারী ও তার স্বামীকে।
শনিবার এসআই রেজাউল করিম তাকে বিচারালয়ে তুললে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত গৃহবধূ সালমাকে জামিন দেন। সে রাতে থানায় কী হয়েছিল, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পুলিশ কিভাবে তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করল, তা সবিস্তারে গণমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন সালমা। যদিও ওই নারীর অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন পুলিশ ও অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা।
সালমা জানান, রাজধানীর দারুস সালাম এলাকায় সপরিবারে বসবাস করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে তার পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসউদ্দিন। অবশিষ্ট অংশও দখলের জন্য সন্ত্রাসী নিয়ে একাধিকবার হামলা করেছেন তিনি। এ বিষয়ে একাধিকবার থানাপুলিশের সহযোগিতা চাইলেও পুলিশ তাকে সহযোগিতা করেনি।
পরিবর্তে নেতার পক্ষ নিয়ে পুলিশ উল্টো তাকে হয়রানি করেছে। এ ঘটনায় সালমা আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। মামলার পর থেকেই গিয়াসউদ্দিন তার সহযোগীদের দিয়ে নানা হুমকিধমকি দিতে থাকে। এ ঘটনায় থানায় জিডিও করা হয়।
গত শুক্রবার দুপুরে গিয়াস তার লোকজন নিয়ে আবারও সালমার ওপর হামলা চালায়। অবস্থা বেগতিক দেখে দুপুর আড়াইটার দিকে ৯৯৯-এ ফোন দেন। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ সালমা ও তার স্বামী সোহেলকে বাড়ির কাগজ নিয়ে থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন। থানায় যাওয়ার পর সালমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় পুলিশ। রাতে ওসি থানায় এসে সালমাকে গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে জোর করেন। রাত ১১টা পর্যন্ত তাকে হুমকি দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দিতে থাকেন। তবে মামলা প্রত্যাহারের পর গিয়াসউদ্দিনের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার হামলা বা বসতবাড়ি দখল করবে না, এমন অঙ্গীকার চাইলে তাতে রাজি হননি ওসি। পরে ওসির নির্দেশে এসআই রেজাউল করিম বাদী হয়ে সালমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ রয়েছে, এক সময়ের হকার গিয়াসউদ্দিন এখন কয়েকশ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। মিরপুরে রয়েছে তার একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট। তিনি সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বাবার স্মৃতি বসতবাড়িটি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সালমা চৌধুরী।
পুলিশের করা এজাহারে সালমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, সালমা হরিরামপুর বাসার সামনে গিয়াসউদ্দিন নামে লটকানো সাইনবোর্ড অপসারণ করেন। ওই সাইনবোর্ড অপসারণ করাকে কেন্দ্র করে গিয়াসউদ্দিনের ম্যানেজার ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করাসহ উত্তেজিত হয়ে মারমুখী আচরণ করেন এবং ধারাল হাঁসুয়া নিয়ে খুন-জখমসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।
আসামিকে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করা না হলে খুন-জখমসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনা অথবা যে কোনো প্রকার ধর্তব্য অপরাধসহ প্রাণনাশের আশঙ্কা কোনোভাইে নিবৃত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তাকে ফৌ.কা.বি ১৫১ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। মামলাটিতে পুলিশ গৃহবধূ সালমাকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দেখায়।
আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষ হয়ে ‘সাজানো মামলা’র বিষয়টি মিথ্যা দাবি করে দারুসসালাম থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ জানান, আইন মেনেই ওই নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিও ভিত্তিহীন দাবি করেন ওসি।
আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াসউদ্দিন জানান, শুক্রবার সালমাই গিয়াসের ম্যানেজার ফরহাদকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু দৌড় দিয়ে বেঁচে যায় ফরহাদ। পরে পুলিশ গিয়ে সালমাকে রামদাসহ গ্রেপ্তার করে। মামলার সময় তিনি থানায় ছিলেন না দাবি করে গিয়াসউদ্দিন জানান, রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য একটি মহল তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এদিকে ঘটনার পারির্পাশ্বিকতায় খোদ থানার একাধিক কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, দেখা করার নামে ওসি সাহেব যেটা করেছেন, তা নজিরবিহীন। বাদীকে ডেকে এনে এভাবে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো আইনের পরিপন্থী। আওয়ামী লীগ নেতাকে বাঁচাতে যেটা করা হয়েছে, তাতে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাবে। বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তারা।