অতিরিক্ত সচিব খলিলুর রহমান সহ ৪৮ আসামিকে অব্যাহতি দুদকের;তদন্ত ও অনুসন্ধান প্রশ্নবিদ্ধ!
অতিরিক্ত সচিব খলিলুর রহমান সহ ৪৮ আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দুদকের;‘ক্লিনশিট’পেয়েছে দুর্নীতিবাজরা। খলিলুর রহমানকে রক্ষা করতেই ৪৮ আসামিকে অব্যাহতি। (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অপরাধীদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
অপরাধ প্রতিবেদকঃ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা ও তদন্তকাজ থানা পুলিশ বা শৃঙ্খলাবাহিনীর অন্য কোনো সংস্থার মতো নয়। পুলিশ আগে মামলা নেয়, পরে তদন্ত করে সত্য উদ্ঘাটন করে।
আর দুদক আগে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান শেষে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হয়েই মামলা করে। সেটাও অনুসন্ধান কর্মকর্তা একক ইচ্ছায় করেন না।
অভিযোগের সত্যতা তথ্যপ্রমাণে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই কেবল মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। কমিশন সন্তুষ্ট হয়ে তাতে অনুমোদন দিলে দুদক বাদী হয়ে মামলা করে।
এরপর সংস্থাটির কর্মকর্তারাই করেন তদন্ত। এতসব প্রক্রিয়া শেষ করার পরও কোনো কোনো মামলায় তদন্ত পর্যায়ে অব্যাহতি পাচ্ছে আসামি।
এমন এক ঘটনায় দুদকের অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়ার পর একজন ঊর্ধ্বতন আমলা সহ মামলায় আসামি করা হয় ৪৮ জনকে।
কিন্তু সংস্থাটির তদন্তেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে সবাই। অর্থাৎ অনুসন্ধানে ‘হ্যাঁ’ ও তদন্তে ‘না’-এমন স্ববিরোধী সিদ্ধান্তে দুদকের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লিখিত ঘটনার অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। খোদ দুদক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেছেন, অনুসন্ধান প্রতিবেদনে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ দেখে সন্তুষ্ট হয়ে মামলার অনুমোদন দিলেও তদন্ত পর্যায়ে কমিশনের অবৈধ প্রভাব ও স্বগোত্রীয় কিংবা প্রভাবশালী আসামিদের তদবিরে সত্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটের বদলে দেওয়া হয়েছে ফাইনাল রিপোর্ট। এতে ‘ক্লিনশিট’ পেয়েছে দুর্নীতিবাজরা।
অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট দিতে চাইলেও তাকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে বাধ্য করা হয়। এ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা থাকলেও প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারেন না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অপরাধীদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। এটা কেন করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
এখানে ‘সরষের মধ্যে ভূত’ আছে কি না, তা বের করতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করার এখতিয়ার দুদকের। দুদক বিচারক নয়। আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত বা শাস্তি হবে কি হবে না, তা বিবেচনায় মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার এখতিয়ার দুদকের নেই।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘অভিযোগের অনুসন্ধানের পর সত্যতা পাওয়া গেলেই দুদক মামলা করে এটা ঠিক। তবে মামলা তদন্তের পর এফআরটি দেওয়ারও বিধান আছে।’
একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য ঘটনায় সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে এফআরটি দেওয়া দুদকের তদন্ত ও অনুসন্ধান কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমন ঘটে থাকলে পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে। কমিশন মনে করলে মামলাটি পুনঃতদন্ত করে দেখা যেতে পারে।’
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত মামলা সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় (নথি নম্বর ০০.০১.২৬০০.৬০৩.৯৯.০০৬.১৮) থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন একটি রাস্তা অবৈধ বরাদ্দ প্রদানের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হয়। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
সেখানে বলা হয়েছে, টিকাটুলি বলদা গার্ডেনের পশ্চিম পাশে সিটি করপোরেশনের নামে রাস্তা হিসাবে রেকর্ডকৃত ভূমি ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা কোনোক্রমেই লিজ প্রদানযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত জমিটি যে রাস্তা, তা উল্লেখ না করে আবেদন করেন অভিযুক্তরা। আবেদনে রাস্তার দাগ, খতিয়ান গোপন করে শুধু জায়গার অবস্থান বর্ণনা করা হয়। সেই আবেদন গ্রহণ করা হয়।
এরপর ‘তদন্ত করে প্রতিবেদন সহ উপস্থাপন করুন’-এ মর্মে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা বিলাল হোসেনকে নির্দেশ দেন করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান।
সম্পত্তি কর্মকর্তা, সার্ভেয়ার, কানুনগো সহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা পর্যায় ক্রমে ইতিবাচক মত দিয়ে সেটি নথি আকারে প্রশাসকের কাছে উপস্থাপন করেন। প্রশাসক খলিলুর রহমান তাতে অনুমোদন দিলে আবেদনকারীদের অনুকূলে বরাদ্দপত্র জারি করা হয়।
এরপর বরাদ্দগ্রহীতাদের সরেজমিনে দখল বুঝিয়ে দেন সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় দায়ী ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশন সভায় উপস্থাপনের পর ৪৮ জনের বিরুদ্ধেই মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়।
জানা যায়, অনুমোদন পাওয়ার পর দুদক কর্মকর্তা বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি শাহবাগ থানায় পেনাল কোডের ধারা ৪৭৭এ/১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ৫(২) ধারায় মামলা করেন।
মামলায় ৪৮ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারে বলা হয়, আবেদনকারীদের নামে বরাদ্দ প্রদানের জন্য সরাসরি প্রস্তাব আইনানুগ ছিল না। লিজযোগ্য সিটি করপোরেশনের জমি ইজারার জন্য নির্ধারিত পদ্ধতি রয়েছে।
প্রয়োজনীয় আইনানুগ কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা না দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পর্যায়ক্রমে ওই প্রস্তাব অনুমোদন করলে ১ থেকে ৪৩ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত আসামিরা জমির দখল বুঝে নেন।
সেখানে সেমিপাকা দোকান নির্মাণ করে অপরাপর ব্যক্তিদের অনুকূলে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়, আসামিরা অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে বরাদ্দ প্রদানের অযোগ্য ভূমি (রাস্তা) বিধিবহির্ভূত ভাবে বরাদ্দ ও দখল বুঝিয়ে দিয়ে জনস্বার্থের ক্ষতি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
আদালত থেকে পাওয়া নথিতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তদন্তের দায়িত্ব পান তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত শেষে তিনি ৪৮ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের সুপারিশ সহ সাক্ষ্য স্মারক দাখিল করেন।
২০২১ সালের ৮ নভেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে এক ‘কোয়ারিতে’ আসামিদের পক্ষ নেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধস্তন কর্মচারীদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট স্থানটি অস্থায়ী ভিত্তিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক সব ক্ষেত্রে অধস্তন কর্মচারীদের প্রতিবেদন সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য মাঠে যাওয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অধস্তন কর্মচারীদের ভুলের দায় ঊর্ধ্বতনদের ওপর বর্তায় না মর্মে কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়।
এছাড়া তদন্ত কালে করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ওই স্থাপনা অপসারণ করা হয়েছে মর্মে লিখিত ভাবে কমিশনকে অবহিত করেছেন।
ফলে এ মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হলে ‘কজ অব অ্যাকশন’ থাকবে কি না এবং আদালতে মামলা প্রমাণের সম্ভবনা কতটুকু রয়েছে, তা পুনঃপর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন।
কমিশন সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ৪২ জনের সম্পৃক্ততা একই রকম না হওয়ায় মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পুনঃতদন্তের দায়িত্ব পান দুদকের উপপরিচালক পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা।
অভিযোগ আছে, পুনঃতদন্তের নামেই মূলত নতুন তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়ে মামলার সব আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশসহ আদালতে ‘ফাইনাল রিপোর্ট এজ ট্রু’ (এফআরটি) জমা দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
২০২২ সালের ১৮ মে দাখিলকৃত পুনঃতদন্ত প্রতিবেদন ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে কমিশন সন্তুষ্ট হয়ে এফআরটি দাখিলের বিষয়টি অনুমোদন দেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যে ৪৩ জন জায়গা বরাদ্দ পেয়েছিলেন, তারা ছাড়াও মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন সার্ভেয়ার মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন, মুহাম্মদ বাচ্চু মিয়া, কানুনগো মোহাম্মদ আলী, সম্পত্তি কর্তকর্তা মোহাম্মদ দিদারুল আলম ও প্রশাসক (অতিরিক্ত সচিব, অবসরপ্রাপ্ত) মো. খলিলুর রহমান।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, খলিলুর রহমানকে রক্ষা করতেই ৪৮ আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে মামলার এফআরটি করানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার কারণে সব আসামি অব্যাহতি পেয়েছে-এমন কথা সঠিক নয়। মামলার তদন্তে আমার প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত কর্মকর্তা বক্তব্য নিতে আমাকে একবার ডেকেছিল, আমি দুদকে গিয়ে আমার বক্তব্য দিয়ে এসেছিলাম। এছাড়া দুদকের অন্য কারও সঙ্গে আমার কোনোদিন কথা হয়নি। মামলার এফআরটি হয়েছে, সেটাও আমার জানা নেই।’