চেনা শহর – সাগর চৌধুরী

Picsart_22-07-13_19-29-26-880.jpg

চেনা শহর – সাগর চৌধুরী

ভালোবাসাটা জানি কেমন ? ধরা যায় না। ছোয়া যায় না। আবার বুকেও আগলে রাখা যায় না। আসলে এর যে কি রূপ, তাও বোঝা যায় না। রুপমকে তার কি যে ভালো লাগত !

তার কথা শুনলে কেমন নেশা নেশা লাগত। তার হাসিতে তার হৃদয় ভেসে যেত । আর সেই রুপম এখন চোখের কাটা। তার সাথে যেন দেখা না হয় এজন্য সে পরিচিত রাস্তা দিয়ে হাঁটে না ।

ইউনির্ভাসিটির যাবার আগেই রিকসা ওয়ালাকে বলে দেয়-‘এই টিএসির সামনে এলে দ্রুত যাও । কেউ ডাকলে দাঁড়াতে হবে না।’

এই রুপমের জন্য সে কত দিন দাঁড়িয়েছিল ! কতদিন নীলক্ষেতের দুর্গন্ধময় হোটেলগুলোতে সস্তা দামের খাবার খেয়েছে।
কতদিন রুপমের সাথে ঘুরতে বের হয়ে হলের দাড়োয়ানের হুমকি শুনেছে ! সন্ধ্যা আটটার সময় গেট বন্ধ হলেও ফিরতে ফিরতে তার দশটা বেজে গেছে। এমনো হয়েছে সকালে কিছু না খেয়ে বেড়িয়েছে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেছে। কিছু খাওয়া হয় নি সারা দিন । পকেটে পয়সা ছিল না বলে ।

বই কিনতে টাকা দিয়েছে বাড়ি থেকে। সেই টাকা বলাকায় সিনেমা দেখে শেষ করেছে সে। পরীক্ষার দু’দিন আগে নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সস্তা দামে বই কিনতে গিয়েও ষাট টাকা বাকি ফেলে রেখেছে। বইয়ের দোকানদার তো বাকিতে বই
দিবেই না । পরে অনেক অনুনয় বিনয় করে দোকানদারকে বলেছে ‘মামা বইটা না নিতে
পারলে পরশুর পরীক্ষায় একেবারে ফেল মারব।’
একটা একুশ-বাইশ বছরের মেয়ের ষাট টাকার জন্য এত অনুনয় বিনয় দেখে পাশের দেকানদার বলেছে-‘এই বইয়ের টাকা আমি দেবে । বই দিয়ে দে।’

দোকানের লোকটা অবশ্য বলেছে—‘এরকম অনেকেই বই বাকি দিয়েছি কিন্তু টাকা কেউ দিয়ে যায় নি ।’

রুপম দেখতে একটা খুবই চমৎকার ছেলে । আর্মি কাট চুল । সেভ করলে একেবারে হিরো হিরো লাগত।
ওকে প্রথম দেখেই কেমন পিলে চমকে গিয়েছিল। ভেবেছিল; এই ছেলে কখনো কি আমার সাথে প্রেম করবে ?

প্রেম রুপম ঠিকই করেছিল তার সাথে । কিন্তু এই কি প্রেমিকের ধরন ? এখন তার কথা মনে পড়লেই মনটা কেমন হয়ে ওঠে। অতীত জীবনের সেই দিনগুলো ভাবতেই মনের ভিতর কেমন হয়ে যায়। ভাবনাগুলো দল পাকিয়ে কান্না হয়ে ভেসে আসে চোখে । কিন্তু
এই কান্নার কথা কার কাছে বলে সে ?

প্রেম করার সময় কেউই অন্য কারো সাথে আলাপ করে না। বোঝাপড়া যা হয় নিজের মধ্যেই । তার কি দোষগুণ এগুলো প্রথম দেখায় বোঝা যায় না। মানুষের বাইরের রূপ দেখে ভিতরটা চেনা যায় না। ভিতরটা চিনতে হলে তার সাথে মিশতে হয়, তার সাথে কথা
বলতে হয় । তারপর বোঝা যায় কেমন সে। কিন্তু এতটা বছর পর তার এই মনোভাবকে
কেইবা পাত্তা দেয় । নিজের কাছেই নিজেকে নিছক হাসির পাত্র মনে হয়। এই কথা কার কাছে বলা যায় ? কে শুনবে ? সবার কাছেই কি সব কিছু বলা যায় ?

প্রেমের বছর খানেক না যেতেই একদিন রুপম বলল—‘চল আমরা চিড়িয়াখানায় যাই।’
রুপমের কথায় সে সময় বলা চলে অন্ধ । সে যা বলত কখনোই না ছিল না । ফিরব কখন এমন কোন প্রশ্নও না ।

শীতের দিন শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চারদিকে কুয়াশার আচ্ছাদন । হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোকা বনে যাবার পালা, পাঁচটা বাজে ! দ্রুত বের হতে না হতেই রুপম বলল- “ভয়ের কিছু নেই মিরপুর দুই নম্বরে আমার এক দোস্ত আছে; আজ ওখানেই থাকা যাবে।”
এবার প্রশ্ন “আজ রাতে?”
সে রাতের কথা আর নাই বা বলা হলো।

একটা আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে তেইশ-
পরের দিন হলের গেটে রিকসা থেকে নেমে হেঁটে হলের রুমে যাব; এতটুকু শক্তিও সে আমার রাখে নি।
অবশ্য সে এক অন্য রকম শিহরণ ! অন্য রকম উত্তেজনা ! অন্য রকম অনুভূতি !

চিড়িয়াখানা থেকে ফেরার মাসখানেক পর বেঁকে বসল চল যাই— লালবাগ কেল্লায় ।

পুরান ঢাকায় যেতে অল্প কয় টাকা রিকসা ভাড়া। ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে রিকসা নিয়ে বিকেল বেলা লালবাগ কেল্লায়। রাজা-বাদশার গল্পে মশগুল। আরো মশগুল রুপমের চালচলনে, কথাবার্তায়, আবেগি হাতের জড়ানো বেষ্টনিতে।

সন্ধ্যার সাথে সাথেই হলে ফিরব । ‘পুরান ঢাকায় এসেছি বিরানি না খেয়ে ফিরে যাব, এটা কেমন করে হয় ?’ বললো রুপম । পুরান ঢাকার বিরানি বিখ্যাত । এটা কে না জানে কিন্তু রুপমের মনের গোপন ইচ্ছেটা কে জানে?
জগনাথ ইউনিভার্সিটির সামনে হয়ে বলধা গার্ডেন । তারও ভেতরে গিয়ে একটা খাবারের দোকানের সন্ধান করে সেখানে বসার ব্যবস্থা হলো। পুরান ঢাকার বিরিয়ানি।

রুপমের খাবার দেখে চমকে যাবার পালা । প্রশ্ন করতেই উত্তর আসে ‘দুপুরে খাবারের টাকা নেই ।
তাই খাওয়া হয় নি।’ রিকসা ভাড়া দিয়ে; পার্স খুঁজে একশো টাকার নোট পাওয়া গেল
একটা । ততক্ষণে বিরিয়ানির বিল এসে হাজির দুশো চল্লিশ টাকা।

কিছু বলতে হয় নি। রুপমই কি সব মিথ্যা বলে সেখান থেকে পার পেয়ে এসেছে।

রিকসায় নাকি ওর মানি ব্যাগ পড়ে গিয়েছে । অথচ যখন সে এই মিথ্যে কথাগুলো বলছিল, তখন তার পেছনের পকেটে মানি ব্যাগটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । ও খুব সাজিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারতো ! ছেলে হিসেবে মাশআল্লাহ, লাক্ষে এক পিস!

একদিন সন্ধ্যায় হলে ফিরছি। এমন সময় এসে পথ আগলে দাঁড়ালো। বললো-“টাকা চাই ।’ এর আগে বহু বার সে টাকা নিয়েছে।

ফেরত দেবার তো নাম নেই, ইদানীং টাকা চাওয়ার মাত্রটা এতবেশী বেড়েছে যা রীতীমত অসহ্য। কি হবে টাকা দিয়ে? প্রশ্নে সে নিরুউত্তর! এতগুলো মেয়ের সামনে যেভাবে সে আমাকে টাকার জন্য ধরেছে, না দিলে
আমিই যেন লজ্জায় পড়ে যাই । কি আর করা । দিতে হলো শ’চারেক।

তার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে জানা গেল । সে নেশায় মত্ত । কি সেই নেশা ? লাল না গোলাপি রঙের এক ধরনের ট্যাবলেট আছে; সেই ট্যাবলেটের । মুখোমুখি দাঁড়ালাম ।

এসব কি ? সে এমনভাবে এড়িয়ে গেল, এমনভাবে কথায় যুক্তি দিল, এমনভাবে আমার কথাগুলোকে স্টানবাই করলো আমি তাকিয়ে রইলাম। এটা কি করে সম্ভব ?
ও ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় অষ্টম হয়েছে। এস.এস.সি, এইচ.এস.সিতে দুটোতেই
প্লাস পাওয়া ছেলে । কিন্তু তার কি হাল ! সে নেশাখোর । তার কাছে নেশা করার টাকা না থাকলে সে পাগল হয়ে যায় । দিকবেদিক ছুটতে থাকে । তার কোন হিতা হিত জ্ঞান থাকে না। টাকার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। টাকা যার কাছে আছে সে তার কাছে ছুটে যাবে ।
আসলে যে নেশা করতে টাকা লাগে। এই টাকা সে কোথায় পায় ?

শীতের একটা গরম জামা কিনে দিয়েছি গতবার । মনে হয় সে পরেছেও বেশ কয়েকদিন। তারপরে আর সেটা পাওয়া যায় নি । প্রশ্ন করলে বলেছে-“হল থেকে নিয়ে গেছে কেউ।’ কিন্তু শুনেছি কোন ছোট ভাইয়ের কাছে টাকা নিয়েছে ধার, ফেরত দিতে পারে নি । ছোট
ভাই টাকা চেয়েছে । সে তার কাছে জানতে চেয়েছে-টাকা নিয়ে কি করবি ?’ জুনিয়র ছেলেটা বলেছে শীতের জামা কিনবো। গায়ের থেকে গরম জামাটা খুলে দিয়ে দিয়েছে
তাকে, নে পর ।

আমি তো একটা মেয়ে মানুষ তাই না ? এত কষ্ট করে বাবা-মা পড়াশুনা করতে ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছে, ওর মত একটা নেশাখোর ছেলের সাথে প্রেম করার জন্য ?
বাসা থেকে আমার জন্য যে টাকা পাঠায়, তার চার ভাগের এক ভাগ দিয়ে আমি চলেছি আর বাকি তিন ভাগ প্রতি মাসে ওকে দিয়েছি নেশা করার জন্য । ওর প্যান্ট লাগে আমি কিনে দেই। ওর জামা লাগে আমি কিনে দেই। এমন কি সেভ করার রেজারটা পর্যন্ত আমার কেনা। এরকম প্রেমিককে কতদিন নিজের বলে রাখা যায়?

যা বাবা! একদিন ভেবেছিলাম রুপম আমার সাথে প্রেম করবে? সে কান পেতে আমার কথা শুনবে? বুঝবে আমার ভালো লাগা খারাপ লাগা বিষয়গুলো। কিন্তু কে চায় বড্ড নেশাখোর ছেলের সাথে এভাবে নিজেকে জড়াতে? কে আপনি চান? হ্যাঁ, অন্যদিকে তাকালে হবে না।

প্রশ্নটা আপনাকেই করেছি। আপনি চান নিজেকে জড়াতে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top