চাপা কান্না থামছে না প্রশাসনে; জুনিয়রদের অধিনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন
বিশেষ রিপোর্টঃ অতিরিক্ত সচিব পদেই ৭ বছর ধরে চাকরি করছেন, কোনো অভিযোগ নেই, নেই বিভাগীয় মামলা। কাজ করছেন সুনামের সঙ্গে। অথচ আজও সচিব হতে পারেননি। ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি শেষ ধাপে পৌঁছে যাওয়ায় চার বছর ধরে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিও বন্ধ। অথচ গ্রেড-১ স্কেলেও পদোন্নতি মেলেনি। এই কষ্ট নিয়ে ১৯৮৫ ব্যাচের বহু মেধাবী কর্মকর্তার চাপা কান্না থামছে না।
১৯৮৪ ব্যাচেরও অনেকে এমন মানসিক কষ্ট নিয়ে চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছেন। বাদ যায়নি ৮৬ ব্যাচ। কারও ভাগ্য আবার যুগ্মসচিবেই আটকে গেছে। তারা বলছেন, সবাইকে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব না হলেও যাদের সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল, ইমেজ ভালো, সচিব পদে পদোন্নতির ফিটলিস্টেও নাম ছিল, কিন্তু তারাও তো বাদ পড়েছেন। কী দুর্ভাগ্য! এখন কয়েক ব্যাচ জুনিয়রের অধীনে তাদের চাকরি করতে হচ্ছে। নিগৃহীত হতে হয় জুনিয়রদের কাছেই। কি কপাল! এই জুনিয়রদেরই শিখিয়ে পড়িয়ে প্রশাসনে যোগ্য করে গড়ে তুলছেন তারা।
গণমাধ্যমের হাটুর বয়সী কর্মীর কাছে এমন সব কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন কয়েকজন সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত সিনিয়র ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব। তবে সঙ্গত কারণেই তারা নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। প্রশাসনে জুনিয়র বা এসিল্যান্ড ও uno দের মত কর্তাকর্তাদের কাছে তাদের কোন মূল্যই নেই। অতছ এই জুনিয়রদেরই শিখিয়ে পড়িয়ে যোগ্য কর্মকর্তা হিসেবে গড়েছেন তারা।
সম্প্রতি পিআরএল বা অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া সিনিয়র ব্যাচের একজন অতিরিক্ত সচিবের বিষয়টি এই ক্ষোভ-অসন্তোষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। গত ৩০ জুন অবসরে যান ১৯৮৫ ব্যাচের মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে সুপরিচিত মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার। ওএসডি হওয়ার আগে যার কর্মস্থল ছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সরকারের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের শীর্ষ পদে চাকরি করলেও বিন্দুমাত্র কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কাজ করেছেন পুরোনো মেজাজে। ব্যাচমেট ও সহকর্মীদের অনেকের মতে, তার নিরপেক্ষতা ও সততা ছিল প্রশ্নাতীত। যে কারণে অতিরিক্ত সচিব পদে দুবছর চাকরি করার পর ব্যাচমেটসহ সিনিয়ররা তাকে বলতেন ‘তুমি কনফর্ম সচিব হচ্ছ।’ কিন্তু বিধি বাম। তার চোখের সামনে দিয়ে একে একে অনেকে সচিব হয়ে গেল। ব্যাচমেট ছাপিয়ে বর্তমানে আরও তিন ধাপ নিচে ১০তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও সচিব। ১১তম ব্যাচ সচিব হওয়ার পথে। কিন্তু তিনি সচিব তো দূরের কথা, কর্মরত থাকাবস্থায় গ্রেড-১ পদে পদোন্নতিও পাননি। চাকরি জীবন শেষ হওয়ার ২ দিন আগে তাকে গত ২৭ জুন গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দিয়ে ওএসডি করা হয়। যথারীতি তিনি ৩০ জুন অবসরে যান। অর্থাৎ এই পদোন্নতি ছিল তার জন্য এক ধরনের ‘নীল বেদনা’। তিনি এখানে ১০ মাস কর্মরত অবস্থায় সচিব পদমর্যাদার স্কেল গ্রেড-১ ভোগ করতে পারলেন না। আর্থিক সুবিধা ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। অথচ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ডিজি পদটি অনেক আগেই গ্রেড-১ পদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অবসরে যাওয়া এবং কর্মরতদের মধ্যে কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব গণমাধ্যমে বলেন, ‘কিছুই বলার নেই। যিনি দেখার তিনি নিশ্চয় বিচার করবেন। আমাদের মতো অনেকের এই চাপা কান্না হয়তো কেউ কোনোদিন দেখবে না। তবে এতটা অন্যায় করা ঠিক হয়নি। কী অপরাধ ছিল আমাদের? এত মেধাবী হয়েই বা কী লাভ হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ বছর পূর্তি হয়ে গেল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা মেধার স্বাক্ষর রেখে লেখাপড়া শেষ করেছি। প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছি। কিন্তু আমাদের পেছনে ফেলে অন্যরা সচিব হয়ে গেল। এ কষ্ট আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।’
তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের কোনো অনুযোগ কিংবা অভিমান নেই। তিনি তো তার প্রতিটি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘প্রশাসনে সৎ, যোগ্য ও মেধাবীদের মূল্যায়ন করা হবে।’ তবে দায়ী হলো তারাই, যারা হতে দেয়নি। সঠিকভাবে তাদের নাম যারা প্রস্তাব করেননি। একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘সাত বছর ধরে অতিরিক্ত সচিব পদে চাকরি করছি। আমিসহ আমার ব্যাচের ৫-৬ জনের নাম তখনো সচিব পদে পদোন্নতির জন্য অনুমোদন করার তালিকায় ছিল। আমাদের বলাও হয়েছিল, শিগগির সচিব করা হচ্ছে। অথচ একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে আর করা হলো না। কে বা কারা নানান খোঁড়া যুক্তি সামনে এনে আমাদের বাদ দেওয়ার সব ব্যবস্থা পাকা করলেন। অলিখিতভাবে সাফ বলে দেওয়া হলো, ৮৬ থেকে তদূর্ধ্ব ব্যাচের কোনো অতিরিক্ত সচিবকে আর সচিব করা হবে না।
তিনি বলেন, ‘যেসব অফিসার এক সময় সামনের চেয়ারে বসার সাহস করত না, স্যার বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলত, যাদের আমরা এসিআর দিয়েছি, এখন তাদের অধীনেই চাকরি করতে হচ্ছে। এর চেয়ে আর কোনো কষ্ট থাকতে পারে? তবে এখনো চাকরি আছে ১০-১১ মাস। হয়তো এভাবেই করে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সচিব পদে পদোন্নতি না দিলেও অন্তত সচিব স্কেলের পদ গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দিয়ে যদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর বা সংস্থায় আমাদের দিয়ে কাজ করানো হতো, তাহলেও কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তেমনটি মনে হচ্ছে না।’
অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, সচিব পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিক সরকারের। এটি সব সময় ছিল। কিন্তু আমরা মনে করি, এখানে দুটি স্বার্থই সমানভাবে বিবেচনা করা উচিত। প্রথমত, দেশ বা রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বার্থ বা প্রাপ্যতা। কিন্তু এর বাইরে ভিন্ন কিছু বিবেচনায় নিয়ে সচিব করা হলে অধিকতর যোগ্য ও মেধাবীদের এভাবে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। শুধু একটা কথা বলতে চাই, ‘যারা ‘আমাদের লোক’ খুঁজে দেওয়ার ফর্মুলা বের করল-তাদের সবাই কী আসলে আপনাদের লোক?’
একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘কোনো অভিযোগ আর দিতে চাই না। কারণ অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না। ডিজিটাল যুগে সবাই সবার সব খবর রাখে। কোনো কারণে হয়তো প্রকাশ্যে বলে না। যাহোক আমাদের ব্যাচগুলো যদিও অনেক বড় ছিল। তা সত্ত্বেও মোটামুটি ব্রাইট অফিসাররা সচিব হয়ে গেলে এত প্রশ্ন উঠত না। তবে এখনো যারা চাকরিতে আছেন তাদের মধ্যে অধিকতর মেধাবী ও প্রফেশনাল সিনিয়র অতিরিক্ত সচিবদের জন্য সম্মানজনক কিছু একটা করা উচিত। মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই এক সময় অবসরে চলে যাব। এই ক্ষমতা, এত শক্তিশালী চেয়ার কিছুই থাকবে না। অতীতের বহু ক্ষমতাবানরা অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। তাই মনে রাখার মতো আমাদের ভালো কাজগুলোই এক সময় পাথেয় হবে।’
এদিকে ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের কয়েকজন গণমাধ্যমে বলেন, ‘সরকারপ্রধানসহ এসএসবির (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) সভাপতি ও সব সদস্যের কাছে পদোন্নতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। ইতোমধ্যে এসএসবির সদস্যদের কয়েকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখাসাক্ষাৎ করেও এই বিব্রতকর অবস্থার কথা তুলে ধরে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে এসএসবি আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে তাদের বাকি সমস্যার কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে। সচিব পদে পদোন্নতি ছাড়াও বিকল্প ভাবে সম্মানিত করার সুযোগ তো আছেই।’
আমরা চাই সকলের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রমেশন ও অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। প্রশাসনের এই যদি হয় উপরের মহলের চাপা কান্না তবে নিম্নস্তরের বুকফাটা কান্না শুনাবো আরেক দিন।