সম্পদের পাহাড় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আক্তারুজ্জামানের!
অপরাধ প্রতিবেদকঃ স্বাস্থ্যের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আব্দুল মালেকের পর এবার অঢেল সম্পদের হদিস পাওয়া গেলো চতুর্থ শ্রেণির আক্তারুজ্জামান খাঁনের। কাজ করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম (ইনফরমেশন, এডুকেশন ও মোটিভেশন) বিভাগে। পদের নাম প্রজেকশনিস্ট। ঢাকার মিরপুরে ছয় তলা একটি বাড়ির মালিক তিনি। চলেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। রয়েছে বিলাশবহুল ফ্ল্যাট। একতলা আরেকটি বাড়ি কিনেছেন। সেটা আপাতত কারখানা হিসেবে ভাড়া দেওয়া থাকলেও শিগগিরই সেখানে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা আছে। প্লটও রয়েছে একাধিক। বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ারে রয়েছে দোকান। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটের প্রজেকশনিস্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন আক্তারুজ্জামান। তার দায়িত্ব ছিল ঢাকা ও এর আশেপাশের জনবহুল এলাকায় পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন কর্মসূচি প্রচার করা। ২০০১ সালের পর থেকে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন কর্মসূচি প্রচারের পাশাপাশি অফিসের নথিপত্র দেখাশুনা করেন তিনি। তখন থেকেই ‘কপাল’ খুলে যায় তার। গণেশ চন্দ্র সরকার নামে আইইএম বিভাগের সাবেক এক পরিচালকের মাধ্যমে বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত কর্মসূচির টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন তিনি। জাইকা, ইউএনএফপি, ইউনিসেফ, বিকেএমআই, ইউএসআইডি, ডব্লিউএইচওসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের আইইএম ইউনিটের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ দিত। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে কমিশনের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন আক্তারুজ্জামান। এ ছাড়া টিভিতে একই নাটক-নাটিকা বছরের পর বছর প্রচার করা হলেও বিল তুলে নেওয়া হতো ঠিকই। টিভি বিজ্ঞাপনেও তুলনামূলক কম জনপ্রিয় কলাকুশলীদের নিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে অর্থ তোলা হতো বেশি। একইভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বিলবোর্ডের মাধ্যমেও।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল আক্তারুজ্জামানের। কেউ তার দুর্নীতির প্রতিবাদ করলেই তাকে বদলি করে দেওয়া হতো ঢাকার বাইরের কোনও জেলায়। ২৬ বছরের চাকরিজীবনে আক্তারুজ্জামান নিজে কোথাও বদলি হননি।
সম্প্রতি আইইএম ইউনিটের কোটি কোটি টাকার কাজের ভাগাভাগি নিয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এ কারণে একে অপরের বিরুদ্ধে সবাই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে থলের বেড়াল।
আইইএম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল (স্মারক নং ১৩৮১৮), ১৬ মে (স্মারক নং ১৬২৬৬), ৫ জুন (স্মারক নং ১৮৩৮৬), পয়লা জুলাই (স্মারক নং ১৮৩৮৬) ও সর্বশেষ ৯ সেপ্টেম্বর (স্মারক নং ২৭২৬৫) পাঁচ দফা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়ে আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করে দুদক। তবে অজানা কারণে মাঝে তার বিরুদ্ধে তদন্ত স্থবির হয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর নতুন করে তদন্ত শুরু করে দুদক।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আক্তারুজ্জামান খাঁনের বাড়ি
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আক্তারুজ্জামান খাঁনের বাড়ি
দুদকের এক কর্মকর্তা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এজন্য কারোর তদন্তে সময় লাগছে। পর্যায়ক্রমে সকলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আক্তারুজ্জামানের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর প্লটের ছয় তলা বাড়িটি তার। রোকশানা মঞ্জিল নামে ওই বাড়িতে ১২টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
২০১৪ সালে তিনি এই বাড়ি নির্মাণ করেন। একই এলাকার পাশের ৩১ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর প্লটের অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তলায় তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পাশের ৩৩ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর প্লটে রয়েছে একতলা একটি বাড়ি। পাশের টেক নামে আরেকটি এলাকায় একটি বাড়ি, মিরপুরের সেনপাড়ায় একটি প্লট, মিরপুরের হাজী আব্বাস উদ্দিন স্কুলের পাশে এভিনিউ ৫ এর ১৫ নম্বর লেনে ২ কাঠার একটি প্লট রয়েছে। এ ছাড়া বাড্ডা এলাকার সুবাস্তু টাওয়ারে ছেলে আসিফ খানের নামে একটি দোকান কিনেছেন আক্তারুজ্জামান। গাজীপুরের বোর্ড বাজারে ৩ কাঠার একটি প্লট ও গাজীপুর সদরে তিন কাঠার একটি প্লট রয়েছে। আক্তারুজ্জামান চলাফেরা করেন নিজস্ব প্রাইভেটকারে। তবে গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-৩৯৬৯) তিনি শ্যালিকার নামে কিনেছেন বলে জানা গেছে।
আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল থানাধীন নান্দাইল ইউনিয়ের আহমেদবাগ গ্রামে। তার বাবার নাম মো. মালেক। আক্তারুজ্জামানের বাবা একসময় গ্রামের বাড়ির পাশে টং দোকান করতো। কিন্তু বর্তমানে গ্রামের বাড়ির চারদিকে সীমানা প্রাচীর তুলে রেখেছেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, গত কয়েক বছরে আক্তারুজ্জামানের অস্বাভাবিক উত্থান হয়েছে। এক দশক আগেও এত সম্পত্তির মালিক ছিলেন না তিনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটের কর্মচারী আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ছুটিতে থাকা অবস্থায় অফিস সময়ের পর অফিসে ঢুকে নথিপত্র চুরি করার অভিযোগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নং ৩৩৪) করা হয়েছে। আইইএম ইউনিটের উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ মোল্লা গত ৬ নভেম্বর এই জিডিটি দায়ের করেন।
জিডিতে বলা হয়েছে, প্রজেকশনিস্ট আক্তারুজ্জামান খান কার্যালয়ের সকল কার্যক্রমেই জড়িত ছিলেন। তিনি আইইএম ইউনিটের কোটেশন, বিল ভাউচার তৈরি, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে বিল প্রেরণ ও বিলের বিপরীতে চেক গ্রহণের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
দায়িত্ব পালনকালে তিনি নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় তাকে সতর্ক করা হয়। তার কৃত অপরাধের আলামত নষ্ট করার জন্যই ছুটিতে থাকা অবস্থায় অফিস সময়ের পর অফিসে প্রবেশ করে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সংশ্লিষ্ট নথিপত্র, বিল ভাউচার সরিয়েছেন।
জানতে চাইলে এই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক মাসুদুল, ‘জিডির তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইইএম ইউনিট কর্তৃপক্ষকে মামলা করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ এখনও এ বিষয়ে মামলা দায়ের করেনি।’
প্রজেকশনিস্ট আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর দুটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করে তাকে লক্ষ্মীপুরে বদলি করেছিল। কিন্তু তিনি সেখানে যোগদান না করে ঢাকাতেই অবস্থান করছেন। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের প্রশাসন ইউনিটের উপ-পরিচালক (পার্সোনাল) ইফতেখার রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে (স্মারক নং-৫৯.১১.০০০০.১৫৩.২৭.০২০.২০.৮৭) আক্তারুজ্জামানের বিষয়ে বিভাগীয় মামলা নেওয়া ও বদলির কথা উল্লেখ করে দুদক কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। চিঠিতে বদলির পরও আক্তারুজ্জামান কর্মস্থলে যোগদান করেননি সেই বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে বিভাগীয় মামলার তদন্ত বন্ধ রাখার জন্য আক্তারুজ্জামান পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে বিপুল অর্থ দিয়েছেন। লক্ষ্মীপুরে যোগদান করলে তার প্রাণনাশ হতে পারে এমন একটি ‘কারণ’ দেখিয়ে বদলির আদেশ স্থগিত করার আবেদনও করেছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় প্রতিটি ইউনিটেই দুর্নীতি ও লুটপাট একটি নিয়মিত চিত্র হওয়ায় আক্তারুজ্জামানকে নিয়ে আলাদা করে কারও মাথাব্যথা নেই। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মহাপরিচালক হোসনে আরা বানু, প্রশাসন বিভাগের পরিচালক হেমায়েত হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য জানা যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছে, আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিভাগীয় মামলা ধীরগতিতে এগোচ্ছে।
দুর্নীতি ও বিপুল সম্পদের বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে আক্তারুজ্জামান খাঁন সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার যেসব সম্পত্তি রয়েছে, তা পৈত্রিকভাবে অর্জিত। গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় বাড়ি করেছি। এ ছাড়া ব্যাংক থেকেও আমার ঋণ নেওয়া আছে।’ সরকারি নথি চুরি ও বদলির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইইএম ইউনিটের শীর্ষ কর্মকর্তারা শত্রুতা করে আমার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছে। আর বদলি স্থগিতের জন্য আমি আবেদন করেছি।’