আহমদ শফী হাটহাজারী মাদ্রাসার কর্তৃত্ব হারালেন
চট্রগ্রাম প্রতিনিধিঃ বৃহস্পতিবার রাতে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির (শূরা কমিটি) বৈঠকে শফী পদত্যাগ করেন এবং তার ছেলেসহ দুই শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে শূরা কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন নানুপুরী জানিয়েছেন।
বৈঠকের পর প্রায় শতবর্ষী আহমদ শফীকে মাদ্রাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম শহরের একটি হাসপাতালে।
এর মধ্য দিয়ে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় দৃশ্যত আহমদ শফীর সুদীর্ঘ দিনের কর্তৃত্বের অবসান ঘটল।
এই মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন আহমদ শফী, যাদের কাছে তিনি ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত।
এই কর্তৃত্বে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি পদে রয়েছেন।
এছাড়া হেফাজতে ইসলাম নামে সংগঠনের আমিরের দায়িত্বও তিনি পালন করছেন কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্বের উপর ভর করেই।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত বাংলাদেশের অন্যতম বড় এবং পুরনো কওমি মাদ্রাসা। সাত হাজারের বেশি শিক্ষার্থী সেখানে অধ্যয়ন করে।
আহমদ শফী কয়েক দশক ধরে মাদ্রাসাটির মুহতামিম বা মহাপরিচালকের পদে ছিলেন। মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালকের পদে ছিলেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী।
দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ শফীর উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে কয়েক মাস আগে বাবুনগরীর সঙ্গে শফী সমর্থকদের দ্বন্দ্ব বাঁধে। তাতে বাবুনগরীকে সরিয়ে দিয়ে শফী সমর্থকরা টিকে গেলেও তার রেশ থেকে গিয়েছিল।
শফীর পরে কে, হাটহাজারী মাদ্রাসায় তৎপরতা
পদ হারালেন বাবুনগরী
চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় বুধবার আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করে একদল শিক্ষার্থী
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কিছু দিন বন্ধ থেকে মাদ্রাসা খোলার পর বুধবার আকস্মিকভাবে মাদ্রাসার কয়েকশ’ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে।
তারা শফীর অব্যাহতি এবং তার ছেলে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানির বহিষ্কার দাবিতে বিভিন্ন কক্ষে ভাংচুরও চালায়।
তাদের অন্য দাবির মধ্যে ছিল- আনাস মাদানি কর্তৃক অব্যাহতি দেওয়া তিন শিক্ষককে পুনর্বহাল, আনাসের নিয়োগ দেওয়া সব ‘অযোগ্য ও বদ আখলাকের’ শিক্ষক ও স্টাফকে ছাঁটাই এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর সব ধরনের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ করা।
বুধবার মাদ্রাসার শূরা কমিটি বৈঠক করে আনাস মাদানিকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিক্ষুব্ধরা শান্ত হলেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার গুঞ্জনে তারা বৃহস্পতিবারও নামে বিক্ষোভে।
এই পরিস্থিতিতে সরকার কওমি মাদ্রাসাটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও অধ্যক্ষকে বৃহস্পতিবার একটি চিঠি পাঠায় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
ওই চিঠি পাওয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রাতে আহমদ শফীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার শূরা কমিটি।
বৈঠকে ১২ সদস্যের শূরা কমিটির পাঁচ সদস্য এবং মাদ্রাসার প্রবীণ ‘ওস্তাদরা (জ্যেষ্ঠ শিক্ষক)’ উপস্থিত ছিলেন বলে জানান সালাহউদ্দিন নানুপুরী জানান।
তিনি বলেন, “অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বড় হুজুর। তবে তিনি আমৃত্যু ছদরে মুহতামিম (উপদেষ্টা) হিসেবে থাকবেন। তিনি মাদ্রাসা পরিচালনা ও নতুন মুহতামিম মনোনয়নের দায়িত্ব শূরা কমিটিকে দিয়েছেন।”
এছাড়া মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক (শিক্ষা) আনাস মাদানি এবং শিক্ষক মাওলানা নুরুল ইসলামকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান নানুপুরী।
গত দুদিন ধরে মাদ্রাসা পরিস্থিতির দিকে চোখ রেখে আসা হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, “আল্লামা শফীর পদত্যাগের খবরটি মাদ্রাসার ভেতরের মাইক থেকে শুনেছি। তবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু অবহিত করেনি।”
চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় বুধবার আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভের সময় ভাংচুরও চালায় একদল শিক্ষার্থী
বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে গত দুদিন ধরে মাদ্রাসার সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিয়ে আছে। তারা শিক্ষার্থীদের বাইরে বের হতে বাধা দিলেও নিজেরা ভেতরে ঢোকেনি।
সেখানে থাকা চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা রাতে বলেন, “মাদ্রাসার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। শূরা কমিটির বৈঠকের পর আল্লামা শফীকে চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম নেওয়া হয়েছে।”
বার্ধক্যজনিত কারণে অনেক দিন ধরে শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন আহমদ শফী। গত কয়েক বছরে তাকে বেশ কিছু দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। মাঝে ভারতেও চিকিৎসা নিয়ে আসেন তিনি।
গত ১১ এপ্রিল হজম এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়ায় নগরীর বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল আহমদ শফীকে।
পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তিন দিন পর তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে গেণ্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সুস্থ হয়ে গত ২৬ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রামে ফেরেন।
শাহ আহমদ শফীর জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। তার বাবার নাম বরকম আলী, মা মোছাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফী দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।
তার দুই ছেলের মধ্যে আনাস মাদানি হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। অন্যজন মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক।
শফীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। এরপর পটিয়ায়র আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসায় (জিরি মাদ্রাসা) লেখাপড়া করেন। ১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান, সেখানে চার বছর লেখাপড়া করেন।
১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন আহমদ শফী। এরপর থেকে টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি ওই পদে ছিলেন।
দেশের আলেমদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র আহমদ শফী বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে নয়টি বইয়ের রচয়িতা।
তবে নারীবিরোধী নানা বক্তব্যের জন্য বরাবরই সমালোচিত আহমদ শফী।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমে আলোচনায় উঠে আসেন আহমদ শফী।