চিঠি – শাহানা সিরাজী
পুরো আকাশ জুড়ে একটি চাঁদ , সে চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত মাটি-ধরণী। কান পেতে থাকি
কখন খবর আসবে খবর আসবে. হ্যাঁ, সে এসেছে। যার অপেক্ষায় দিন আর রাত কাটে । সব কাজে মন যেন উড়– উড়– , আকাশের দিকে তাকাই, ইস যদি পাখি হতে পারতাম! একদিন অফিস শেষ করে গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে। হাঁটতে পারছি না, জয়েন্ট পেইন, অমনি তোর বাবার ফোন বেজে উঠলো, আম্মু আম্মু কন্যা তো এসেছে।
-আরে কখন?
-এইতো মাত্র কিছুক্ষণ আগে।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। ডাক্তার প্রেস্ক্রিপশন বাদ দিয়ে আমাকে পরখ করলেন। বললেন আপনার ঔষধ এসে গেছে।
মিষ্টি কিনতে আমার ভুল হয়নি। চারদিকের চেনা জগতকে অচেনা লাগছে।
আমি দাদু হয়েছি আমরা দু গোলার্ধের দুজন। মাঝখানে নিরকক্ষ রেখে,পুরো আটলান্টিক- তারপর আছে পাসপোর্ট-ভিসা। কোথা যাবো! কী করবো!
যতোবার তোকে দেখতে যাবার কথা ততোবারই নানান প্রতিকূলতা দেখেছি। হৃদয়ের প্রেম থাক হৃদয়ে। তোর বাবাকে আচ্ছা বিরক্ত করি। দাদুন কী করে রে!
তোর বাবাও ফোন স্ক্রিন ধরে রাখে। আমি দূর থেকে তোর চোখ-মুখ-নাক-কান পরখ করি। কান্না শুনি। তৃষ্ণা তো আর শেষ হয় না। তোর বাবা ক্লান্তিতে নুইয়ে যায়। তোকে দেখা তোর মাকে দেখা, লেখাপড়া, সংসারের কাজ-সব এ হাতেই করছে। ভাবি কেমন করে পারলো আমার ছেলে! সেদিনও যখন দেশ ছাড়তে যাচ্ছে আমিই তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছি। তোর বাবা বলতো, আম্মু বাসায় আমি কেন হাত ভেজাবো!্্ সেই ছেলেটি তোকে পেয়ে কেমন বাবা হয়ে উঠলো। তোকে খাওয়ানো, নাওয়ানো ঘুম পাড়ানো সবই সে দক্ষ হাতে করছে। একদিন বয়সের পর থেকে যে বাবার কোলে চড়েছিস সে থেকে কোলেই। তোকে কোলে নিয়েই তোর বাবার পিএইচডি শেষ হলো। জন্মের পর তোর সাথে প্রথম যার পরিচয় হলো তা ল্যাপটপ । স্বজন বলতে তোর বাবা আর মা। তাই তখন থেকেই গুটি গুটি চোখে তাকিয়েই থাকিস ,বাবা ,মা কী ভাবে কী করে!
এক বছর বয়সে তোকে নিয়ে তোর বাবা দেশে ফিরেছে। আমি অস্থির। কোলে নেবো নাকি বুকে রাখবো! চিনতে পারার কথা নয়। কিন্তু একটু সময়েই আপন হয়ে উঠলি। যেন কতকাল ধরে চিনিস। সত্যিই তো দাদুন, আমরা তো জনমের সখি। লাওহে মাহফুজে এক সাথেই ছিলাম।
আগে আমি এলাম তোর দাদুন হয়ে পরে, এলি তুই আমার প্রাণপাখি হয়ে।
তোর চাচ্চু এত্তোগুলো বেলুন নিয়ে এলো তোকে প্রথমদেখার সময়। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলি, চোখে কী প্রশ্ন ছিলো রে! একটু পরেই চাচ্চুর কোলে চাপলি। চাচীটি তোকে পেয়ে যেন চাঁদ পেয়েছে। সে কটাদিন যেন ছিলো স্বপ্ন, আমার অফিস নেই, তোর চাচীর বাপের বাড়ি নেই, চাচার পড়ালেখা নেই। সবার সব কিছু জুড়েই কেবলই ইনারা নুসাফ্রিন সিরাজী। অফিসার্স ক্লাবে আয়োজন হলো তোর প্রথম জন্মদিন পালনের। উদ্যোক্তা তোর চাচ্চু। সকাল থেকে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে ছিলো,তোর চাচীর আব্বু, তোর আরেক দাদাভাই। সেদিনই মনে হলো, আমি দাদু,আমার কোলে আমার নাতনী,প্রবল পূর্ণিমার সাথে শেফালীর বন্ধন। তোর বাবা-মাকে খুশি দেখলে আমার দুনিয়া বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তোর চাচ্চু- চাচী কতো কী পুতুল এটা সেটা দিয়ে সাজিয়ে তুললো তোর থাকার ঘর। পুরো মাস জুড়ে । ঘুম ভাঙার পরে চাচীর ঘরে নক দিয়ে তাদের মাঝখানে জায়গাদখল ছিলো তোর সত্যিকারের রক্তের ডাক।
চাচার বিছানায় গড়াগড়ি ,কানে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি তারপর পলাশফুলের মতো দিগন্ত বিস্তৃত । তোর হাসি সবার কাছেই পরম আরাধ্য।
দাদুন, দেখতে দেখতে কেমন করে এক মাস চলে গেলো। তোদের চলে যাবার দিন যতো গড়িয়ে এলো ততোই যেন শূন্যতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো। বুকের ভেতর পাহাড়ের মৌনতা, চোখের ভেতর কর্ণফুলীর তীব্র¯্রােত। পায়ের পাতা অনুভূতিহীন। কিন্ত নিয়তিকে মানতেই হবে। যাবার বেলা অসুস্থ হয়ে গেলি। পেটে সমস্যা হয়ে গেলো। কিছুই ভালো লাগলো না . চিৎকার করে কাঁদছিলি। খুব কাঁদছিলি। জানতি না তো আমাদের বিচ্ছেদ ঘটতে যাচ্ছে …
এয়ার পোর্টে ইমিগ্রেশন হওয়ার পর বুঝি জেনেছিস, আর দেখা হবে না,তাই বুঝি উল্টো দৌড় দিয়েছিস। এপারে আমি তোর চাচ্চু-চাচী ও পারে তুই । আমাদের চোখে শ্রাবণমাস, চারদিকে থই থই জল। সে জলে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
তারপর থেকে আমার দিন কাটে তোকে ভেবে। আমার দুটো ছেলেকে যতোবার ভাবি তারচেয়ে বহুবার ভাবি তোকে। কী করছিস? কেমন করে আউলা চুলের জুটি করিস, কেমন করে লকলকে ধান হচ্ছিস বড়ো। ইচ্ছে করে, মুখ ধুয়ে দিই, চুল বেঁধে দিই,আঙুল ধরে একটি একটি বর্ণ শেখাই, মুখে মুখে রাজারানীল গল্প বলি। নতুন করে স্বপ্ন গাছের বীজবুনি।
সারাটাদিন জ্বালাবী খুব, মেকি মুখ ভার করে বলবো দাদু, শীঘ্রই চলো,ঘুমাবে এখন- তোর তখন বায়না হবে, না দাদু ছবি আঁকবো। ভাতঘুমে নুইয়ে যাবো তবুও আমি থাকবো বসে তোর সাথে ধলেশ্বরী নদী হয়ে।
পিয়ানোর কী-বোর্ড নেচে ওঠে তোকে ভেবে,হারমোনিয়াম হিহি হাসে,বলে ইনারা কোথায়? আমার শক্তি, আমার মুক্তি, আমার বন্ধন আমার কারাগার সবই যে তোর বাবা-চাচা আর তুই। কখনো তোকে কাছে পাবো না এ দুঃখ দাদু কোথায় রুই!
হ্যাঁ দাদু তোর বাবার স্বভাবে আমার উপস্থিতি আছে রে! প্রচÐ চাপা, একাগ্র, দুর্দমনীয়, কর্মচঞ্চল এবং স্বনির্ভর, তোর মাঝেও সে সবের উপস্থিতি দেখতে পাই। তাই আমার সারাউনডিং বলে, দাদুর মতো নাতনী। সবসময় প্রার্থনা করি যেন হোস তোর বাবা-মায়ের মতো। আমার ভিউ অনেক পুরোনো, পৃথিবী সবসময় গতিশীলদের গ্রহণ করে। প্রতিটি সময়ের ভিন্ন ভিন্ন দাবী। সে দাবীতে হয়ে উঠিস অনন্য। তোর বাবা কখনো তোর দাদার পরিচয়ে কোথাও দাঁড়াতো না। নিজের আইডেনটিটি তৈরীতে সে ব্যস্ত ছিলো। তোর দাদার নাম সততার কারণে সারাবিশ্বে পরিচিত। হাজার কোটি টাকায় সে নাম কেউ অর্জন করতে পারবে না কখনো। যখন বড়ো হবি, দাদা-দাদীকে খোঁজ করবি, ঠিক জেনে যাবি, ইনারা নুসাফ্রিন সিরাজীর দাদা-দাদী কে ছিলো!
দাদুন, দেখতে দেখতে এবার তুই তিন পার হলি. চারে পড়লি,এতো দিনে তোর মুখে খই ফোটার কথা। দাদু দাদু ডাক অনেক আগ থেকেই হয়তো শুনতাম যদি কাছে থাকতাম। কিন্তু দূর থেকে দেখি, বাবার কোলে,ঘাড়ে ও চেপে বেড়াচ্ছিস, বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়াস । মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমুচ্ছিস। কল্পালোকে খুব কাছে থাকিস ,প্রায়শই মনে হয় দাদুন আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, যেন আধো আধো বোল তুলে বলছিস,দাদুও দাদু আমায় কোলে নাও। চমকে উঠি। আকাশের দিকে হাত বাড়াই, চাঁদের আলোয় স্থির দাঁড়াই। যেখানেই থাকি আমরা এক আকাশের নিচেই আছি।
তোর জন্য দাদুর কতো কবিতা- ছড়া -গল্প। কবে বাংলা শিখবি, কবে সব তোর কাছে দেবো। তোর বাবা তোকে এমেরিকান কালচারেই বড়ো করবে। হয়তো বাংলা শেখাবেই না! অযথা তোর কষ্ট বাড়াবে না। সে বড়ো বাস্তববাদি মানুষ! কিন্তু দাদু যতো বেশি ভাষা জানা যায় ততোই মানুষ মানুষকে বোঝে। ততোই মানুষ সমৃদ্ধ হয়। জীবন আর সৃষ্টির রহস্য ততোই স্পষ্ট হতে থাকে।
জানিস দাদু, এ জগতে অভাব কিসের?
বিশ্বাসের আর ভালোবাসার।
মানুষ যে দিন থেকে সেল্ফসেন্টারড হয়েছে সেদিন থেকেই মানুষের মন থেকে উঠে গেছে- সুখ। কী পেলে মানুষ সুখি হয়,তা যদি মানুষ জানতো তাহলে আজকের সভ্যতা কখনো জাগ্রত হতো না রে!
তোর ভেতর আমার রক্ত মিশেল আছে তাই আৎকে উঠি, তুই যদি আমার মতো হোস, নিজের প্লেটের খাবারও অন্যকে দিয়ে দিস, যদি নিজের কাজল অন্যের চোখে মেখে দিস, ভাবিস যদি থাক না মানুষ ভরসায় , বেঁচে থাকুক তাহলে আমার মতোই ঝরবি দাদু। লোকে যাই বলুক তৃপ্তি কিন্তু থাকেই। সময়কে উড়িয়ে দিয়ে যদি এগিয়ে থাকিস তাহলে অন্যতম কেউ হয়ে পৃথিবীকে করবি ঝঞ্জালমুক্ত। রাষ্ট্র ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। এ সত্য যদি মনে প্রাণে আঁকড়ে ধরতে পারিস তাহলে তোর কাছে পরাস্ত হবে ট্রাম্প, ওবামা,ক্লিন্টন। লক্ষ্য স্থির করাটা জরুরী। স্বপ্ন দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বটে তবে তা ঘুমিয়ে নয় দাদু। চ্যালেঞ্জগ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নই হলো প্রকৃত মানুষের কাজ। মানবতার কল্যাণই হলো প্রকৃত অন্তরের কাজ।
দাদুন, এখন যে তোর নিজেকে তৈরীর সময়,মানুষের ভীড়ে অনন্য হতে হলে, পড়তে হবে লিখতে হবে, নাচতে হবে গাইতে হবে। দাবাড়– আর সাঁতারু না হলে যে বুদ্ধি বাড়বে না।
এবার জন্ম দিনে তোর বাবা দেখিস তোকে লেখা শেখানোর প্রত্যয়ে দৃঢ় হবে। সেও চার বছর বয়সের আগেই পড়তে এবং লিখতে শিখেছিলো।
দাদুন কালের চক্র ঘুরে ঘুরে আসে. আমার দাদু আমার বিয়াল্লিশ বছর বয়সেও ভাবতেন, আমার কষ্ট হচ্ছে। অফিস থেতে ফেরার পথে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন,কখন ফিরবো! এখন আমি থাকি কখন দাদুর এক একটি পরিবর্তন আসবে। আবার তুইও থাকবি দাদু…
এ চিঠি তোর কাছে পোঁছাবে না জানি, কিন্তু থেকে যাবে আমার ইউটিউব চ্যানেলে, যেদিন একা একা ব্রাউজ করতে শিখবি সেদিন শুনতে পাবি- আমি তোকে ডাকছি- দাদুন ,দাদুন দাদুন
শুভ জন্মদিন দাদু- অন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত হও আত্মীয় অনাত্মীয় সবার মাঝে। এক বাক্যে সবাই যেন বলে-ইনি ইনারা নুসাফ্রিন সিরাজী।
দাদুন দাদুন যতোই ডাকি
ততোই দূরে যাই
ততোই মারে ঘাই
ততোই তোরে চাই..
শুভ জন্মদিন।
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর, পিটিআই
মুন্সীগঞ্জ
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।