রাজস্ব আদায়ে আসছে পরিবর্তন; ১৩৯ কোটির গরমিল
বিশেষ প্রতিবেদকঃ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতর ও মাঠপ্রশাসন কর ব্যতীত রাজস্ব (এনটিআর) আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। কিন্তু গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ দুই কর্তৃপক্ষ যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে, তার চেয়ে ১৩৯ কোটি টাকা কম জমা দেয় সরকারি কোষাগারে!
তাই এবার রাজস্ব আদায় ও কোষাগারে জমা দেয়ার বিষয়ে পরিবর্তন আসছে। নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে সরকারের আভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার হবে বলে দাবি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি ওই পদ্ধতি পরিবর্তন সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. মায়সুর মাহমুদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতর/সংস্থা ও মাঠপ্রশাসন (বিভাগীয় কমিশনার/জেলা প্রশাসক/উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর ব্যতীত রাজস্ব আদায় করে থাকে। ওইসব দফতর/সংস্থা তাদের আদায় করা রাজস্ব সম্পর্কে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। একইভাবে মাঠপ্রশাসনের আদায় করা রাজস্ব সম্পর্কে বিভাগীয় কমিশনাররা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতর/সংস্থা ও মাঠপ্রশাসনের আদায় করা এনটিআর সম্পর্কে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন।’
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৭-১৮ অর্থবছরে হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও বিভাগীয় কমিশনারদের মাধ্যমে মাঠপ্রশাসন থেকে প্রাপ্ত একই সময়ের প্রতিবেদনে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয় (হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রেজারিতে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা কম জমা দেয়া হয়)।’
‘বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নজরে আসায় ওই দুই কর্তৃপক্ষের রাজস্ব সংক্রান্ত প্রদত্ত হিসাবের অসংগতির কারণ নিরসনকল্পে মন্ত্রণালয়ের অধীন দফতর/সংস্থা ও মাঠপ্রশাসন থেকে নতুন পদ্ধতিতে নতুন ছকে গত ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রাজস্বের সামগ্রিক আদায় সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়। সেইসঙ্গে ছকটিকে সব দফতর/সংস্থা ও মাঠপ্রশাসনে রাজস্ব সংক্রান্ত মাসিক তথ্য প্রদানের ছক হিসেবে প্রবর্তন করা হয়।’
‘রাজস্ব সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রবর্তিত নুতন ছকে তথ্য দিতে হলে আদায় করা রাজস্ব ট্রেজারি রুল সেকশন ৫ এর ১ (১) অনুসরণে অনতিবিলম্বে সরকারি ট্রেজারিতে জমা করে প্রতিবেদন দিতে হবে। ছকে প্রতিটি ট্রেজারি চালান যাচাই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়/বিভাগও এ চালানগুলো পুনরায় যাচাই করতে পারবে’- বলা হয় প্রস্তাবে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ‘নতুন এ পদ্ধতিতে রাজস্ব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হলে দফতর/সংস্থার সমগ্র রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ওপর মন্ত্রণালয়/বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে রাজস্ব সঠিকভাবে আদায় এবং তা যথাসময়ে ট্রেজারিতে জমা করা হবে। ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা করা রাজস্ব যাচাইয়ের ফলে এ খাতে কোনো অনিয়ম/দুর্নীতি/অস্বচ্ছতা থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত হবে। একইসঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দফতর/সংস্থা/মন্ত্রণালয়/বিভাগের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।’
‘এ ছক পদ্ধতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অর্থাৎ রাজস্ব আদায়, আদায় করা রাজস্ব যথাসময়ে ট্রেজারিতে জমা দেয়া এবং ট্রেজারিচালান যাচাইয়ের কার্যক্রম সন্নিবেশিত, এটিকে যেসব দফতর/সংস্থা রাজস্ব আদায় করে থাকে, তাদের রিপোর্টিং ফরমেট হিসেবেও (সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ছকটি সংস্কার করবে) প্রবর্তন করা যেতে পারে। রাজস্ব সংক্রান্ত প্রবর্তিত নুতন ছকের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল খুবই আশাব্যঞ্জক।’
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও মাঠপ্রশাসন থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন পরীক্ষা করতে গিয়ে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা দেখতে পান- মাঠপ্রশাসন থেকে কিছু কিছু কোডে ট্রেজারিচালান করা হচ্ছে, কিন্তু এই কোডগুলো জেলা প্রশাসকের বিপরীতে হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের রক্ষিত হিসাবে দৃশ্যমান নয়। তাই বিষয়টি পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করা হয়।’
‘দেশের সব দফতর/সংস্থার জমা করা রাজস্ব সঠিকভাবে হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের রক্ষিত হিসাবগুলোতে প্রতিফলিত না হলে, এ ক্ষেত্রে দফতর/সংস্থার রাজস্ব হিসাব হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে রক্ষিত হিসাবের সঙ্গে ক্রস চেক করা সম্ভব হবে না, যা সরকারের রাজস্ব সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে বলেও মনে করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।’
এ বিষয়ে সরকারের কেন্দ্রীভূত সমন্বিত বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও হিসাবরক্ষণে ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ পদ্ধতিতে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা চিহ্নিত করে দেশের সব দফতর/সংস্থার প্রাপ্তি হিসাব নির্দিষ্ট সময়ে সঠিকভাবে সংগতি সাধনের জন্য হিসাব মহানিয়ন্ত্রককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার সুপারিশ করা হয় প্রস্তাবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় এও বলা হয়, ‘কর-ব্যতীত রাজস্ব রিপোর্টিং ফরম্যাট হিসেবে প্রবর্তন করা গেলে এবং তা কার্যকরভাবে যার যার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলে, রাজস্ব আদায় আরও বৃদ্ধি পাবে। রাজস্ব আদায় ও তা যথাসময়ে ট্রেজারিতে জমার প্রক্রিয়ায় কোনো দুর্নীতি বা অসচ্ছতা থাকলে, তা চিহ্নিত হবে।’
পাশাপাশি প্রতিটি দফতর/সংস্থার এই রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার প্রতিটি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণের এখতিয়ার অর্থ বিভাগের। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছেন। নতুন পদ্ধতিতে যদি রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা আসে, তাহলে তারা অবশ্যই এটি পরিবর্তন করবেন।