জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ

PicsArt_09-28-12.13.08.jpg

জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ

প্রধান প্রতিবেদকঃ জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ আজ প্রায়ই উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। বিশ্বে নানা অস্থিরতা এবং বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত আর্থিক মন্দার পরও, বাংলাদেশ গত ১০ বছর ধরে সমৃদ্ধি ধরে রেখেছে।

জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়ার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একথা বলেন। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চার দফা সুপারিশ জাতিসংঘে উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।

নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “স্পেকটেটর ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী, গত ১০ বছরে মোট ২৬টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ। এ সময়ে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের ব্যাপ্তি ঘটেছে। যা ১৮৮ শতাংশ। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে যেখানে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার ছিল ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তা বেড়ে চলতি বছরে দাঁড়িয়েছে ৩০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ”

দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নানান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উন্নয়ন কৌশল হিসেবে তার সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, টেকসই প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো বিষয়ের দিকে নজর দিয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় তিন গুণ বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯০৯ মার্কিন ডলার হয়েছে।

গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ”

বরাবরের মতো এবারও বাংলায় দেয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে এই পরিষদে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন, “এই দুঃখ দুর্দশা সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। ” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নয়ন, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের নেতৃত্বমূলক ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশে আমরা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে তা শুরু হতে যাচ্ছে। তার দর্শন ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়ে আগামী বছর জাতিসংঘে আমরা এ উৎসব উদযাপন করতে চাই। ”

এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানসম্মত শিক্ষা, জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপ এবং অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুপাক্ষিকতাকে উজ্জীবিত করার যে আহবান জানানো হয়েছে সেটিকে খুবই প্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে আমাদের যে অঙ্গীকার ও যৌথ আকাঙ্ক্ষা তারই প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। যা জনগণের আস্থা অর্জনে সাহায্য করেছে এবং আমরা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছি। ”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের ২১ দফার রাজনৈতিক অঙ্গীকার মূলত জনগণের কল্যাণের নিমিত্ত গৃহীত অঙ্গীকার। ”

শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়নের দুটি প্রধান অন্তরায় হলো দারিদ্র্য ও অসমতা। দ্রুততম সময়ে দারিদ্র্য হ্রাসকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, তা ২০১৮ সালে কমে হয়েছে ২১ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এই সমস্যার সমাধান না হওয়াকে দুঃখজনক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এবার জাতিসংঘে চার দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “১১ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে। হত্যা-নির্যাতনের মুখে তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ” তিনি বলেন, “সুরক্ষা, নিরাপত্তা, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায়, এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। ”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা এমন একটি সমস্যার বোঝা বহন করে চলেছি, যা মিয়নামারের তৈরি। ”

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া চারটি সুপারিশ হলো-

১। রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্মীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে।

২। বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে।

৩। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।

৪। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণগুলো বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশে ধারাবাহিক উন্নয়ন, সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’, ‘আশ্রয়ণ’, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’-এর মতো আমাদের নিজস্ব এবং গ্রামবান্ধব উদ্যোগসমূহ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম।

জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এতে করে মানুষের মনে মানুষের মনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী জানান, নারী-পুরুষ সমতা এবং বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তির মাইলফলক অর্জনের পর বাংলাদেশ এখন মানসম্মত শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করেছে। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ৫০ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নেমেছে। বিনামূল্যে বই বিতরণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ পর্যন্ত প্রায় ২৯৬ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। শুধু ২০১৯ সালেই ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই বিতরণ করা হয়। ”

সকল নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটি বিশাল নেটওয়ার্ক আমরা গড়ে তুলেছি। এসব কেন্দ্র হতে গ্রামীণ জনগণকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। সেবাগ্রহীতাদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। এসব কর্মসূচির ফলে মাতৃমৃত্যুর হার, নবজাতক ও শিশু মৃত্যুহার, পুষ্টিহীনতা, খর্বকায়তা ও ওজনহীনতার মতো সমস্যাসমূহ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ”

প্রতিবন্ধী, অটিজম এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে এ ধরনের প্রায় ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ব্যক্তি নিয়মিত সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top