ভ্যানে মরদেহের স্তূপ: আত্মগোপনে ডিবির আরাফাতসহ সেই পুলিশ সদস্যরা
অপরাধ প্রতিবেদকঃ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের গা শিউরে ওঠা এক ভিডিও। গুলিবিদ্ধ মরদেহ গুনে গুনে ভ্যানে তুলছে পুলিশ সদস্যরা। পরে একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে সেগুলো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। এমন বীভৎস ও লোমহর্ষক একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন আলোচনায়।
আজ শনিবার (৩১ আগস্ট ২০২৪) দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ঘটনার বিস্তারিত। ওই প্রতিবেদন বলছে, পুলিশের ভ্যানের লাশের স্তুপ করে রাখা মর্মান্তিক ঘটনাটি আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট সেখানকার ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের দেয়াল ঘেষে গুলিবিদ্ধ ৭ শিক্ষার্থীর মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। পরে পুলিশ সদস্যরা লাশগুলো একত্রিত করে ভ্যানের ওপর স্তুপ করে রাখে। পরে লাশগুলো থানায় পার্ক করা একটি পিকআপে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনারই এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিও এটি।
ভিডিওতে পুলিশের ভেস্ট আর হেলমেট পরিহিত যাদের দেখা গেছে, তাদের একজন ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে আত্মগোপনে চলে গেছেন তিনিসহ ভিডিওচিত্রে থাকা পুলিশের সদস্যরা।
অধস্তন কর্মকর্তার ছবির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব ছবিটি আরাফাতের বলে নিশ্চিত করেন। আরাফাতের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। প্রায় দুই বছর আগে তিনি ঢাকা জেলার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন। তার বাবা মো. আরিফ হোসেন বদরটুনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং হরিনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি।
রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর আরাফাত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এখন উপরে আল্লাহ নিচে আপনারা। সেদিন আমরা কোনো গুলি করিনি। অলিগলিতে হাজারো ছাত্র-জনতা আমাদের ঘিরে ফেলেছিল। তবে আমরা গুলি করিনি।
সেদিন কার নির্দেশে ডিবির টিম আশুলিয়ায় দায়িত্বে ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বিপ্লব বলেন, ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহিল কাফী স্যারের নির্দেশে সেদিন আমরা আশুলিয়ায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে ৫ আগস্ট আমরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলাম। নইলে আমাদেরকেও মরতে হতো।
গণহত্যার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ভিডিওচিত্রে থাকা ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সরকারি মোবাইলফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সেদিনের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যমকে জানান, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকার বিজয় মিছিল বের হয়। বিকেলে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করে। এ সময় আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে গেট বন্ধ করে দেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলে ও ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেট ভাঙতে এগিয়ে যান।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ এফ এম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরও চড়াও হন। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেটে অবস্থান নেন। ওসি উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। জবাবে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান।
এর একপর্যায়ে এসআই মালেক, ডিবির ওসি (তদন্ত) আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলিতে আন্দোলনকারীরা দৌড়ে পালিয়ে যান।
থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে বলেন, বিকেলে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসেন। তারা গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসেন।
তিনি আরও জানান, ভ্যানে লাশের স্তুপ করা জায়গাটি পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের গেটে। ওই গেইটের অপরপাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারী এন্ড মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক ফাহিমা আক্তার গণমাধ্যমকে জানান, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে। ৫ আগস্ট বিকেলে সাড়ে ৪টা হবে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে লাশগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে।
আশুলিয়া থানার সামনে ওইদিন প্রাণ হারানোদের মধ্যে ছিল মধ্য জামগড়া শাহিন স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসশাবুর। তার বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার পাশেই রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পিকআপে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিলো নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও আমাদের হয়নি। আমার ভাইয়ের গায়ে নীল গেঞ্জি ছিল। আমরা গেঞ্জি দেখে পোড়া লাশ শনাক্ত করি।
বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের এক অটোরিকশা চালক বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডান-বাম দু’পাশেই গুলি চালায়। গুলি চালাতে চালাতেই তারা নবীনগরের দিকে এগুতে থাকে। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী।