ক্ষমতা খর্ব হলো অডিট কর্মকর্তাদের; নথিপত্র যাচাই-বাছাই করতে পারবে না নিরীক্ষা বিভাগ

Picsart_23-07-03_19-06-57-708.jpg

ক্ষমতা খর্ব হলো অডিট কর্মকর্তাদের; নথিপত্র যাচাই-বাছাই করতে পারবে না নিরীক্ষা বিভাগ

বিশেষ প্রতিবেদকঃ কর আদায়ের আগে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কর নির্ধারণ করতে হয়। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর নির্ধারণ হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা ছিল অডিট বিভাগের।

কর নির্ধারণে কোনো ধরনের সন্দেহ হলে রাজস্ব বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র নিয়ে যাচাই-বাছাই করত অডিট বিভাগ। কিন্তু আয়কর আইন-২০২৩ এ নতুন একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করে অডিট বিভাগের সেই পর্যবেক্ষণের সক্ষমতাকে বাতিল করা হয়েছে।

ফলে এখন থেকে কর নির্ধারণ ও আদায়ে কোনো ধরনের সন্দেহ হলেও রাজস্ব বিভাগের নথিপত্র যাচাই-বাছাই করতে পারবে না নিরীক্ষা বিভাগ।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে আয়কর আইনটি পাশ হয়েছে। যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ পদক্ষেপের ফলে নিরীক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। এতে করসংক্রান্ত রাজস্ব আদায়ে কতিপয় ক্ষেত্রে বাড়তে পারে অনিয়ম। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে রাজস্ব আদায়ের ওপর। আরও জানা গেছে, আইনটি কার্যকরের পর থেকে কর অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ে কোনো নথি যাচাই-বাছাই করতে দেওয়া হচ্ছে না অডিট কর্মকর্তাদের।

জানতে চাইলে অতিরিক্ত উপ-মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সংসদ) মো. আহসান হাবীব জানান, বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৮(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে অডিট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের সব সরকারি দপ্তরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সে অনুযায়ী রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন আয়কর দপ্তরগুলোর কর আদায় ও নির্ধারণ সংক্রান্ত কাগজপত্র নিরীক্ষা করার অধিকার রাখে অডিট ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু নতুন আয়কর আইন পাশ হওয়ার পর মাঠপর্যায়ে অডিট কর্মকর্তাদের নথিপত্র দিয়ে আগের মতো সহায়তা করছে না আয়কর অধিদপ্তর।

অথচ এসব নথি যাচাই-বাছাই করা গেলে প্রকৃত অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে কিনা সেটি নিরূপণপ করা যেত। এতে অনেক সময় আপত্তি দেওয়ার কারণে প্রকৃত রাজস্ব আহরণ কেস টু কেস ভিত্তিতে আদায় বেড়েছে। কিন্তু এখন তা বন্ধ করা হলে অনেক ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জানা গেছে, ভারতীয় উপমহাদেশের আয়করসংক্রান্ত প্রথম আইন হচ্ছে ‘ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট-১৯৯২’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ সংক্রান্ত প্রথম আইন হচ্ছে ‘ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৪’। এ আইনের ১৬৩ ধারায় (এফ ও জি) বলা আছে কর নির্ধারণ সংক্রান্ত সব নথিপত্র নিরীক্ষা করার ক্ষমতা অডিট ডিপার্টমেন্টের।

কিন্তু নতুন আয়কর আইনে এ ক্ষমতা খর্ব করা হয়। আয়কর আইনে ১৯৬ ধারার (১) উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘দেশে বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা কোনো কর নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারবে না।’

অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ সার্বিকভাবে রাজস্ব বিভাগ যেভাবে কর নির্ধারণ করবে এ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তবে ওই আইনের ধারা ৪-এ উল্লিখিত আয়কর কর্তৃপক্ষ এবং কর আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট প্রশ্ন তুলতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মুখ্য কর কমিশনার, মহাপরিচালক (পরিদর্শক), কর কমিশনার (আপিল), কর কমিশনার (বৃহৎ করদাতা ইউনিট), মহাপরিচালক (প্রশিক্ষণ), মহাপরিচালক (কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল), অতিরিক্ত কর কমিশনার (আপিল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল, প্রশিক্ষণ ও পরিদর্শন), যুগ্ম কর কমিশনার (আপিল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল, প্রশিক্ষণ ও পরিদর্শন), উপকমিশনার, সহকারী কর কমিশনার, অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার ও কর পরিদর্শককে বোঝানো হয়েছে।

অডিট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি রাজস্ব বিভাগ কর নির্ধারণ করেছে ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেখানে অডিট আপত্তি দেওয়ার পর সে কর আদায় ৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে এখন আরও কর নির্ধারণ পদ্ধতি যাচাই-বাছাই করা যাবে না। এতে অডিট বিভাগ বুঝতে পারবে না প্রকৃত অর্থে একটি ঘটনায় কর নির্ধারণের অঙ্ক সঠিক পদ্ধতিতে হয়েছে কিনা।

আরও জানা গেছে, আয়কর আইনের ১৯৬ ধারার উপধারা (২) আরও বলা হয়, ‘এ বিধান লঙ্ঘন করিয়া কোনো কর্ম সম্পাদিত হইলে বা কোনো প্রকার প্রশ্ন উত্থাপতি হইলে উহা বাতিল বা অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে এবং উহার কোনো প্রকার আইনি কার্যকারিতা থাকিবে না।’

অর্থাৎ এ বিধান না মেনে কর নির্ধারণ নিয়ে কেউ আপত্তি জানালে সেটি বাতিল বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ বিদ্যমান আইনের বাইরে কেউ কর নির্ধারণের স্বচ্ছতা, পদ্ধতি ও কর নির্ধারণের অঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালে এর জটিলতা শুরু হয়। ওই সময় কর নির্ধারণ সংক্রান্ত কাগজপত্র নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে অডিট ডিপার্টমেন্টের ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিট দায়ের করেছিল (রিট-৫১৫১/২০১৫)। সে সময়ে উচ্চ আদালতের রায় অডিট ডিপার্টমেন্টের বিপক্ষে যায়। পরে ২০২০ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করে অডিট বিভাগ (রিট-৩৫৬৫/২০২০)।

সে প্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ১২৮(১) অনুচ্ছেদ (অডিট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের সব সরকারি দপ্তরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত) উল্লেখ করে রায় দেন। আদালতের সে রায়ে বলা হয়, অডিট ডিপার্টমেন্ট রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব দপ্তরের আয়-ব্যয়, কর আদায় এবং কর নির্ধারণ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র নিরীক্ষার ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

কিন্তু ঘটনাটি সেখানেই শেষ হয়নি। ২০২২ আর্থিক অ্যাক্টে এ ধারা-৯৪ (বি) তে যুক্ত করে অডিট ডিপার্টমেন্টকে কর নির্ধারণ সংক্রান্ত নথিপত্র নিরীক্ষা করার ক্ষমতা থেকে বাইরে রাখা হয়। এরপর ২০২৩ সালে এসে নতুন ভাবে বিধান যুক্ত করা হয় আয়কর আইনে।

আরও সংবাদ পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top