এবং টহল পুলিশ – শাহানা সিরাজী

Picsart_22-11-10_09-58-11-068.jpg

এবং টহল পুলিশ – শাহানা সিরাজী

কাশিমপুর জেলখানা থেকে বেরিয়ে ফয়সাল আকাশের দিকে তাকালো, কতকাল তোকে দেখি না! কেমন আছিস, আকাশ? আমার পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকেছিল কত বছর? পারবি ফিরিয়ে দিতে সেই দিনগুলো?

রোদের আঘাত চোখ সহ্য করতে পারল না, বুজে এলো। ফয়সাল হাত দিয়ে দুচোখ চেপে ধরল। কিছুক্ষণ চেপে রাখার পর আবার তাকালো। ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো। মন ভরে দেখল সবুজ গাছপালা, মুক্ত আকাশ আর পাখির ডানামেলা উড়োউড়ি। পায়ের নিচে ইট পাথরের ঠোকাঠুকি, রাস্তায় গাড়ির ছোটাছুটি।

ফয়সাল হাঁটতে শুরু করলো। কোন মানুষ সে চিনে না। তাকেও কেউ চিনে না। তবুও খুব অদ্ভুত ভাবে সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। ফয়সালের খুব মনে পড়ছে সৌমিত্রের কথা। কবে যে সে ছাড়া পাবে তা সৌমিত্র জানে না। মনে পড়ছে আপেলের কথা। কী চমৎকার তার কন্ঠ। যে ছিল বাচিক শিল্পী, ওমর ছিলো তুখোড় ছাত্রনেতা। ফয়সাল, সৌমিত্র, আপেল ওমর মিলে কাশিমপুর জেলখানাকে একটি আনন্দমহল বানিয়েছিলো।

আজ তাদেরকে রেখে আসতে খুব খারাপ লাগলো। তারাও খুব কাঁদছিলো। তবুও বললো, ভাই যাও, যদি তোমার রানী এখনো তোমার জন্য বসে থাকে, অপেক্ষায় থাকে তাহলে তাকে তোমার সব বলা জরুরী। তুমি যাও। চৌদ্দ বছর গুরুত্বপূর্ণ সময়। এটা যেমন ঠিক তেমনি এ জেলখানায় যারা বিনা দোষে দুষ্ট হয়েছে, যারা বিচারহীন জেলখাটছে তাদের জন্য তোমাকে লড়াই করতে হবে। আপেলের কথায় কী যেন জাদু আছে! সব কয়েদিরা তার কথা শোনে, কবিতা শোনে গান শোনে। ওমরের স্বপ্নালু বক্তৃতায় জ্বলে ওঠে সব কয়েদিরা। ওমর বলে কেউ আইন হাতে নিও না, বরং এখানে যে উৎপাদন ব্যবস্থা আছে তাতে মনোনিবেশ করো।

তোমাদের সবার ভেতর স্বপ্ন আছে, আশা আছে সেগুলোকে এক করো একদিন জেলের গেট আপনা থেকেই খুলে যাবে। তবে মনে রেখো আমি ওমর সব মুখস্ত করে নিলাম।

কোন আদালত কী ভাবে কাকে জেল দিয়েছে, কে কী ভাবে এই জেলে এসেছে সবই মনের খাতায় আর এই জেলখানার লাইব্রেরির সব রেজিস্টারে লিখে রাখলাম। এই কাশিমপুর জেলখানা একদিন অনেক বড় নাট্য ইউনিভার্সিটি হবে। তারা বের হবে তারা সবাই হবে স্ক্রিপ্ট রাইটার। যে স্ক্রিপ্টে লেখা থাকবে অন্যায়ের সূক্ষ্মজাল কী ভাবে কেড়ে নেয় মানুষের কুসুমিত প্রাণ, কী ভাবে ঝরে যায় অফুটিত কলি! ফয়সাল ভাই তার প্রমাণ।

এদেশে কতো মানুষ অন্ধকারে চোখের আলো হারিয়ে ফেলছে,ফেলেছে আরো ফেলবে তার হিসাব কে রাখে? কোন সাংবাদিক আজতক এসেছে আমাদের খোঁজে?

যাও ফয়সাল ভাই,ফ্ল্যাটফর্ম চাই। সেটা তোমাকে দিয়েই শুরু হবে।

ফয়সাল এসব চিন্তা করতে করতে কখন এসে আবার জেলখানার গেইটে দাঁড়িয়েছে তা সে বলতে পারবে না। দীর্ঘদিন জেলে থাকায় জেলের প্রতি তার কী মায়া হয়েছে? নাকি সঙ্গী সহচরদের জন্য মন খারাপ হয়েছে? দুচোখ থেকে দরদরিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। গেইটের দারোয়ান, কেয়ার টেকার কুৎসিত হাঁক ছেড়ে বললো, কী চাই এখানে? এতো বছর জেল খেটেও সাধ মেটেনি? ফয়সাল শান্ত ও ধীর গলায় বললো, টহল পুলিশ কাকে কখন জেলে পাঠায়!
ফিরে এলো গেইট থেকে। কিন্তু যাবে কোথায়? রানী কোথায়? সে ফিরে যায় চৌদ্দ বছর পেছনে।

গলাটা ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। কোথায় পানি নেই। দোকানগুলোতেও আকাল লেগেছে!রানীর আর টাইম নেই, এখনই আসো,এখনই আসো… কতোবার করে বললাম, আজ স্যালারি হতে পারে। তিনমাস ধরে কোম্পানী বেতন দিতে পারছে না। ভদ্রলোক নেহায়েতই ভদ্রলোক।
গতকাল জানিয়েছে, শেষ চালান থেকে তাদের কোম্পানী লাভবান হয়েছে। সব টাকা এক সাথে দিতে না পারলেও যতো সম্ভব দেবে। কিন্তু রানীর যে আজ কী হলো! সকাল থেকেই উতলা। আজ স্যালারি না নিলেও চলবে। আমি রান্না করেছি, এসো খেয়ে যাও। কতো কী বায়না ধরেছে! আমিও আর কী করবো, দেয় ছুট…

রানী সেদিন বেগুনী রঙের শিপন শাড়ি পরেছে। লম্বা চুলগুলো সারা পিঠ জুড়ে খেলা করছে।
কাজল পরেছে, হাত ভর্তি মেটালিক চুড়ি,সাথে গাঢ় লাল লিপিস্টিক। আমি তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলাম। খালাম্মা, খালাম্মা, আজ কী রানীর বরপক্ষ আসবে?

খালাম্মা হেসে বললেন, আসবে কি রে এসেছিস তো!
রানীও লজ্জা পেলো আমিও। আরক্ত মুখে সে দৌড়ে পালালো। আমি আমার খালার গায়ে গা লাগিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, খালাম্মা, তুমি তোমার এই মায়াবীনি অপরূপা মেয়েটিকে কেন আমার সাথে বাঁধতে চাও?

খালা হাসে, পাগল ছেলে! তুই তার চেয়েও সুন্দর। আমার এতো বিষয় সম্পদ কে এগুলো দেখবে? তোর অন্যের দোকানে চাকুরি করে কাজ নেই। কালই আমি বুবুকে খবর পাঠাবো।শীঘ্রই তোদের বিয়ের কাজ সেরে ফেলবো।

খালার আত্মবিশ্বাস আমাকে অস্থির করে তুলেছে। কারণ দিনা আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তার কথা হলো, তোর ভালোবাসার দরকার নেই। আমি বাসি তাতেই চলবে। এদিকে রানীও যে বসে আছে। খালাম্মার কথা মা ফেলবে না। আমি যে কোন দিকে যাবো!

সেদিন রাতে খালার বাসায় খেয়ে দেয়ে আমি বের হলাম দিনার সাথে দেখা করার জন্য। রাত খুব বেশি নয়। আটটা হতে পারে। দিনার বাসায় গেলাম। কলিংবেল বাজার এক মিনিটের মাথায় দিনা দরজা খুলে দিলো। তাকে চঞ্চল প্রজাপতির মতো মনে হয়৷ রানী আর দিনা স্বভাবে বিপরীত। কিন্ত দুজনকেই যে কেউ ভালোবাসবে। আমাকে এক দিক বেছে নিতে হবে। কোন দিকে যাবো? এক দিকে মা-খালা,তাদের দুজনের এক মাত্র পুত্র সন্তান আমি অন্য দিকে এই তীব্রস্রোতস্বিনী দিনা। যে জোয়ারের মতো ভাসায় ভাটির মতোই টানে।

দিনার বাবা কোনদিন মেনে নেবে না। একা বাঁচা অনেক কঠিন। আমি এক নিমিষেই বললাম, দিনা রানীর বিয়ে। রানী সম্পর্কে সে জানে।

শুনেই লাফালাফি করছে। বেশ তো আমার বাঁধা দূর হলো।
তার বলার স্টাইল এমন ছিলো যে বাকি অংশ তখনই বলা অসম্ভব ছিলো। দিনা তখনই বললো, দাঁড়াও আমি আসছি।
বড়লোকের খেয়ালি মেয়ে। কী জানি কী করে!

অপেক্ষায় থাকলাম, কিছুক্ষণের ভেতর সে নিজেকে রেডি করে বললো, চলো লং ড্রাইভে যাবো। ফেরার পথে বিয়ে করবো। আমাদেএ বিয়ে ট্রেডিশন ভেঙে দেবে।
বললাম, তোমার মা বাবা?

বললো, তারা ব্যস্ত, সময় নেই আমাকে দেখার। কিছুই বলবে না।

বললাম, না তা ঠিক হবে না। ড্রাইভে যেতে চাও নিয়ে যাবো কিন্তু বিয়ে নয়।

দিনার যে কী হলো! সব ছুঁড়ে ফেলে মুহূর্তেই রণাঙ্গিনী! ভয় পেয়ে গেলাম। সর্বনাশ এরে কেমনে সামলাবো। আমি ধাতস্তঃ হলাম। গো স্লো। নিজেকে বোঝালাম। দিনার কাঁধে হাত রাখলাম। এই প্রথম দিনার দেহের স্পর্শ। চমকে উঠলাম। বিদ্যুৎ চমকের মতোই দিনা ঝলসে উঠে থেমে গেলো। আমার কাঁধে মাথা রেখে হুহু কাঁদতে লাগলো। আমি প্রমাদ গুণলাম। ফয়সাল স্থির থাকো। তোমার মা খালা মরে যাবে। দিনাকে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলাম। কাঁদলে হয়তো দুঃখ ভুলে যাবে সহজ হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে তাকে সোফায় বসালাম। বললাম, কফি হবে? কোল্ড কফি? বলার ধরণ দেখেদিনা কান্না ফেলে হাসতে শুরু করে। বসো দিচ্ছি। হারু কাকু দুকাপ কোল্ড কফি দাও, সাথে স্ন্যাক্স কিছু দিও। ফয়সাল সন্দেশ পছন্দ করে।

চুপ করে বসে রইলাম। কী করবো!
আচ্ছা দিনা তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাই না?
হ্যাঁ, আমার মা বাবা ভাই বোন সবাইকে তুমি সহ্য করতে পারবে?
পারবো
আমার একমাত্র খালা বসে আছে আমার জন্য, জানো?
জানি। তুমি রানীকেও বিয়ে করিও।
মানে একসাথে দুইজনকেই বিয়ে করবো!
– নইলে তোমাকে হারাতে হবে যে।
– ভেবে চিনতে কথা বলিও।
– তোর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ভেবেছি। তুই তো অত্যন্ত ভালো ছেলে। তোকে সবাই ভালোবাসতেই পারে।আমিও বাসবো বলেই ঝরঝর কেঁদে ফেললো।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললাম,আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আধ ঘন্টা পরে আসছি। ততোক্ষণে তোর বাবা মা ফিরবে নিশ্চয়ই। এখন রাত একটা বেজে বিশ মিনিট।
দিনা বললো, তিনটার দিকে ফিরবে। আজ কোথায় সোমবার। পার্টি ডে।

আমি বেরিয়ে পড়লাম। আসলে দিনাকে কী চাবে ফিরিয়ে দেবো ভাবছিলাম। রানীকে অগ্রাহ্য করার কোন সুযোগ নেই। দিনা বড়লোকের মেয়ে। আমি তো কখনোই বলিনি আমি তাকে ভালোবাসি৷ সব ভাবছি আর সিগারেট খাচ্ছি।

সিগারেটের শেষ চুমুক শেষ হওয়ার আগেই একটা হাত এসে আমাকে ধরলো। চল,বেটা থানায় চল। রাস্তা ঘাটে থাকা লোকগুলো হয় ডাকাত নয়তো ড্রাগ এডিক্ট।

বললাম, ভাই ভুল করছেন, আমি ভালো মানুষ। আমি ফয়সাল। জি শপের জোনাল ম্যানেজার।

কে শোনে কার কথা। ফোনটাও কেড়ে নিয়ে গেলো। আমি না দিনা, না রানী, না মা – কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারিনি।

টহল পুলিশ সেদিন আমাকে জেলে দেয়নি হত্যা করেছিলো আমার স্বপ্ন, আশা আকাঙ্ক্ষা সব কিছুকে। আমি জানি না দিনা কেমন আছে, রানী কেমন আছে? মা বাবা খালা সবাই কেমন আছেন? বেঁচে আছেন? নাকি নেই?

ভাবতে ভাবতে পয়মন্ত ফয়সাল এগিয়ে যাচ্ছ।
তার অফিস যেন কোথায় ছিলো? দিনারা মালিবাগ ছিলো। খালা ছিলো পরীবাগ।

ফয়সালের পা চলে না। সে প্রতিটি মানুষের মুখ দেখতে চায়। কথা শুনতে চায়। হঠাৎ এই দিন দুপুরে টহল পুলিশের একটি গাড়ি তার সামনে দাঁড়ায়।

দু’জন দু’পাশ থেকে তারে ধরে নিয়ে যায় রমনা থানায়। সবাই বলাবলি করছে,অস্ত্র মামলার আসামী ধরা পড়ছে, এবার বেলালের প্রমোশন আঁটকায় কে!

শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top