‘ইয়াবা গডফাদার’ জামিন পাওয়ায় দুই কোটি টাকা খরচে রাজকীয় সংবর্ধনা
জেলা প্রতিনিধিঃ মাদক ও অস্ত্র মামলায় দীর্ঘ দেড় বছর কারাভোগের পর জামিন পেয়ে এলাকায় ফিরেছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান শাহাজাহান মিয়া।
দুই শতাধিক নোহা মাইক্রোবাস, তিন শতাধিক মোটরসাইকেল ও কয়েকটি খোলা জিপে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনায় মেরিন ড্রাইভ দিয়ে এলাকায় আনা হয়। অথচ তিনি একাধিক মাদক মামলার আসামি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ৯ নম্বরে থাকা আলোচিত ইয়াবা গডফাদার।
ঢাকঢোল পিটিয়ে ফিল্মিস্টাইলে বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) বিকেলে পাঁচ শতাধিক গাড়িবহর নিয়ে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পৌঁছান শাহাজাহান মিয়া। এসময় তার গলা ফুলের মালায় ভরিয়ে দেয়া হয়। রাস্তার দুই পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় হাজারো মানুষ। তাদের উদ্দেশে হাতও নাড়েন মাদক ও অস্ত্র মামলায় দীর্ঘ দেড় বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হওয়া বিতর্কিত এ চেয়ারম্যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন দাবি করেন, গায়ে লাগা কালিমা ঢাকতে তার (শাহাজাহান) নির্দেশে রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। গত ১০ দিনের প্রচেষ্টায় প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে সংবর্ধনা সফল করেছে তার সহযোগী ইয়াবা সিন্ডিকেট।
সূত্রের দাবি, সংবর্ধনার জন্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুই শতাধিক নোহাগাড়ি আনা হয়। প্রত্যেকটি নোহার ভাড়া নির্ধারণ ছিল ১৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে নোহার ব্যয় ৪৫ লাখ টাকা। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসা-যাওয়া করা প্রত্যেক বাইককে দেয়া হয়েছে তিন হাজার করে। এতে খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। অন্যান্য যানবাহন বাবদ খরচ হয়েছে আরও ১৫ লাখ টাকা।
সূত্রটি আরও জানায়, সংবর্ধনার জন্য ভাড়া করা এক হাজার লোককে সেদিনের বেতন বাবদ জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। এর বাইরেও ফুল, চা, নাস্তা ও একবেলা খাবারের বিলে খরচ হয় অন্তত ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে ইয়াবা গডফাদার খ্যাত শাহাজাহানকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে।
তিনি যেমন দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্বাচিত সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান তেমনি সর্বকনিষ্ঠ মাদক গডফাদারও। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে সদ্য কারামুক্ত শাহাজাহান মিয়া বলেন, ‘আড়াই শতাধিক নোহা গাড়ি, তিন শতাধিক বাইকসহকারে হাজারো মানুষ আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। তবে সংবর্ধনায় ব্যয় করা টাকার একটি পয়সাও আমি খরচ করিনি। যারা আমাকে ভালোবাসেন তারাই এসব টাকা খরচ করেছেন। তাদের ভালোবাসায় আমি সিক্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দক্ষিণ চট্টগ্রামের নির্বাচিত সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বহিষ্কৃত হয়েছি। জামিন পেয়ে আগে হাইকোর্টে গিয়ে রিট করেছি। তারপরই এলাকায় ফিরলাম। আশা করছি, শিগগিরই আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে। আমার জন্য অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে এখনো হচ্ছে। আমি নির্দোষ, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
এদিকে ইয়াবার গডফাদার খ্যাত শাহাজাহান মিয়ার রাজকীয় সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সচেতন নাগরিকরা।
আবদুল কাদের নামে একজন লিখেছেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে সমাজে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দাপটে ভালো মানুষ আর টিকে থাকতে পারবে না। সীমান্ত এলাকা টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজারে আবারো প্রশাসনে ইয়াবার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি চালু করা হোক।’
আদনান সামি লিখেছেন, ‘একজন ইয়াবা কারবারিকে গাড়িবহরে শোডাউন দিয়ে, গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে? ইনি একজন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি, উনার বাবাও একই অভিযোগে এখনো পলাতক। ধিক্কার জানাই এসব মানুষদের, ধিক্কার জানাই দেশের দুর্বল আইনকে।’
আমিনুল ইসলাম নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘যার পরিবারের সকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। টেকনাফ সীমান্তের আলোচিত ইয়াবা সম্রাট জাফর আলমের ছেলে টেকনাফ উপজেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি শাহাজাহান মিয়াকে এভাবে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নেয়া দুঃখজনক ‘
স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে রাজকীয় সংবর্ধনা নিয়ে বীরেরবেশে এলাকায় ফিরেছেন গড়ফাদার শাহাজাহান মিয়া। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইয়াবা কারবারিরা আরও বেশি বেপরোয়া হতে সাহস পাবে।
বিষয়টি সম্পর্কে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘শাহাজাহান মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখনো তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি।’
একজন শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার এভাবে সংবর্ধনায় এলাকায় ফেরায় ইয়াবা কারবারিরা আরও বেপরোয়া হতে পারে কি-না, এমন প্রশ্নে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি কিন্তু ওইদিন আমি জরুরি বৈঠকে চট্টগ্রামে ছিলাম। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বেনাপোল সীমান্ত থেকে শাজাহান মিয়াকে গ্রেফতার করে বেনাপোল পুলিশ। পরে তাকে জেলা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়।
পরদিন শাহাজাহানের দেয়া তথ্যের ভিক্তিতে অভিযান চালিয়ে তার বাড়ি থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা, চারটি অস্ত্র ও ২৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর কারাগারে থাকাকালীন মাদক মামলায় আদালতে চার্জ গঠন হলে চেয়ারম্যান পদ থেকে শাহাজাহান মিয়াকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ।
দীর্ঘ ১৮ মাস কারান্তরীণ থাকার পর জামিনে বেরিয়ে রাজকীয় সংবর্ধনা নিয়ে এলাকায় এসেছেন সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির আস্থাভাজন জাফর আহমদের ছেলে শাহাজাহান মিয়া। তিনিও বদির কলকাঠিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।