মা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস – আনিসুজ্জামান

মা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস – আনিসুজ্জামান

আনিসুল হকের মা উপন্যাসটির মুদ্রণের ইতিহাস চিত্তাকর্ষক। এট প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দ্বিতীয় সংস্করণে—সেটিই বোধহয় বইটির চতুর্থ মুদ্রণ—তাতে নবলব্ধ তথ্য ও ঘটনা সংযোজিত হয় ২০০৩ সালের জুনে। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে পঞ্চম মুদ্রণে বইটি আবার সংশোধিত হয়। সেইরূপেই এ-বছরে ৪৪তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। আট বছরে একটি উপন্যাস ৪৪ বার মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশে—এ-ঘটনা সামান্য নয়। (এখন ৯৫ /৯৬তম মুদ্রণ চলছে)

উপন্যাসের মূল আখ্যান সরল ও সংক্ষিপ্ত। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ঢাকার বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা ধরা পড়ে। তাদের একজন আজাদ। তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করে পাকিস্তানিরা, কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করতে পারে না। পাকিস্তানি চর এসে আজাদের মাকে বলে, ‘ছেলেকে যদি র্িফরে পেতে চান, তাকে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়।’ মা একমাত্র সন্তানকে দেখার সুযোগ পান রমনা থানায়, গরাদের এপার থেকে। আজাদ বলে, ‘মা কী করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে। সবার নাম বলতে বলে।’ মা বলেন, ‘বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য কোরো। কারো নাম যেন বলে দিও না।’ আজাদ বলে, ‘আচ্ছা। মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে। দুই দিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগ পাই নাই।’ মা বলেন, ‘আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্যে ভাত নিয়ে আসব।’ সেন্ট্রি এসে যায়। বলে, ‘সময় শেষ। যান গা।’ মা হাঁটতে হাঁটতে কান্না চেপে ঘরে ফিরে আসেন। পরের রাতে দুটো টির্িফন-ক্যারিয়ারে ভাত, মুরগির মাংস, আলুভর্তা, বেগুনভাজি নিয়ে মা যান রমনা থানায়। কিন্তু আজাদকে দেখতে পান না। তিনি দৌড়ে যান এমপি হোস্টেলে। সেখানেও আজাদ নেই। আজাদ নেই।

‘এরপরে আজাদের মা বেঁচে থাকেন আরো ১৪ বছর, ১৯৮৫ সালের সেই ৩০ আগস্ট পর্যন্ত। এই ১৪ বছরে তিনি কোনোদিন মুখে ভাত দেননি। একবেলা রুটি খেয়েছেন, কখনো কখনো পাউরুটি খেয়েছেন পানি দিয়ে ভিজিয়ে। মাঝেমধ্যে আটার মধ্যে পেঁয়াজ-মরিচ মিশিয়ে বিশেষ ধরনের রুটি বানিয়েও হয়তো খেয়েছেন। কিন্তু ভাত নয়। এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি।’ মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়েছেন।

এইটুকু ইতিহাসই এই উপন্যাসের উপজীব্য। কিন্তু, লেখক যেমন বলেছেন, এটি ইতিহাস নয়, উপন্যাস। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর বেলায় তিনি সত্যতারক্ষার চেষ্টা করেছেন পুরোপুরি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। সেই আখ্যানে আজাদের মা সাফিয়া বেগমকে আমরা দেখি প্রখর আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী একজন মানুষ হিসেবে। স্বামী ইউনুস চৌধুরী দ্বিতীয় দারপরিগ্রহের পরে আজাদকে নিয়ে ইস্কাটনের প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন ফরাশগঞ্জের বাড়িতে—দুটো বাড়িই তাঁর নামে লেখা, তবে কোনোটারই দলিল নেই তাঁর কাছে। স্ত্রীকে পোষ মানাতে ইউনুস চৌধুরী গুণ্ডা লাগিয়ে সাফিয়া বেগমকে উ ৎ খাত করেন সে-বাড়ি থেকে। আজাদ তখন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ছোটো বাড়ি ভাড়া নিয়ে, গয়না বিক্রি করে, বোনের সন্তানদের নিজের পক্ষপুটে নিয়ে দিনাতিপাত করেন সাফিয়া বেগম। আজাদ ফিরে এসে এমএ পড়তে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, চেষ্টা করে ব্যবসা করে দু-পয়সা রোজগার করতে। তখনই একের পর এক ইতিহাসের নতুন নতুন অধ্যায় রচিত হতে থাকে: সাধারণ নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ। অরাজনৈতিক আজাদও বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধে যায় মায়ের অনুমতি নিয়ে।
করাচি থেকে আজাদের ঢাকায় ফিরে আসা পর্যন্ত কাহিনি কেবল মা ও সন্তানের—ধীরগতিতে বলা। তারপর নির্বাচনের সময় থেকে এ-কাহিনি হয়ে ওঠে আরো অনেকের—ঔপন্যাসিকের কলমে গতি সঞ্চার হয়। প্রথম পর্বে যদি তাঁর অবলম্বিত উপকরণ হয় মাকে লেখা আজাদের চিঠিপত্র, এখন তিনি উপকরণ পান মক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষা ৎ কার থেকে, জাহানারা ইমামের একাত্তরের ডায়েরীর মতো লিখিত সন বিবরণ থেকে, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তিনি পুনর্নিমাণ করেন ঢাকায় গেরিলা অভিযানের বৃত্তান্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরা পড়ার ঘটনা, তাদের উপর নির্মম অত্যাচারের চিত্র। কারো ফিরে আসা-কারো ফিরে না আসার কথা। তারপর আবার তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সার্িফয়া বেগমের প্রতি—১৪ বছর ধরে তাঁর ভাত না-খাওয়া, শীত-গ্রীষ্মে মাটিতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকার ছবিতে। তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করে সাফিয়া বেগম চলে যান ঠিক ওই তারিখেই, যেদিন আজাদকে দানবেরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চলে আসে, তাঁর শববহন করে নিয়ে যায় জুরাইন কবরস্থানে, সমাধিতে লেখা হয় তাঁর একমাত্র পরিচয়—শহীদ আজাদের মা। দাফনের পরেই বৃষ্টি নামে—জাহানারা ইমামের মনে হয়, বেহেশতের দরজা খুলে গেছে আর সেখান থেকে পুষ্পবৃষ্টি করছে রুমীরা, আজাদেরা। তিনি নিজেও স্নাত হন সেই বৃষ্টিতে। উপন্যাসের আরম্ভ সেখানে, শেষও সেখানে।

আনিসুল হকের রচনানৈপুণ্য অনস্বীকার্য। কিন্তু সে-নিপুণতা কোনোভাবেই আরোপিত নয়। তিনি এমনভাবে নিজেই জড়িয়ে পড়েন এই ঘটনাপ্রবাহে যে তিনি এরই অংশীদার হয়ে যান আর পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেন নিজের অভিজ্ঞতা। তাঁর প্রাঞ্জল কথ্যভাষার রূপ হঠা ৎ বদলে যায় ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায়। শ্বাসরুদ্ধকর বিষয়ের বর্ণনা তো হতে পারে কেবল শ্বাসরুদ্ধকর ভাষায়। যেমন,
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে, এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানি জান্তা তার সামরিক বাহিনীকে ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টারসহ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। শুধু ২৫শে মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ, নৃশংসতা, চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, কামান দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া ছাত্রাবাস, ছাত্রাবাস থেকে বের করে এনে কাতারবন্দি করে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা, যেন তারা পিঁপড়ার সারি, আর তুমি অ্যারোসল স্প্রে করে মারলে শত শত পিঁপড়াকে, গণকবর খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া সেইসব লাশ, এখনও মারা না যাওয়া কোনো গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মাটিচাপা পড়ে তলিয়ে যাওয়ার আগে মা বলে কেঁদে ওঠা শেষ চি ৎ কার, শিক্ষক-আবাসে ঢুকে নাম ধরে ডেকে ডেকে হত্যা করা শিক্ষকদের, তার শিশুসন্তানের সামনে, তার স্ত্রীর সামনে, কামানের তোপ দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা সংবাদপত্র অফিস আর খুন করে ফেলা সাংবাদিকদের, আর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া জনবসতি, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে মা আর তার স্তনবৃন্তে মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিশু, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ, তার মুখ থেকে এখনও শেষ হয়নি বিপদ তাড়ানিয়া আজানের আল্লাহু আকবার ধ্বনি, মাংসপোড়া গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস, আর সে-মাংস মানুষের, আর ভীতসন্ত্রস্ত পলায়নপর মানুষদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, পুলিশ ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা বাঙালি পুলিশদের, ইপিআর ব্যারাকে হামলা চালিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গুলি করে মারা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘেরাও করে ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নির্বিচারে পাখি মারার মতো করে হত্যা করা, লাশে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, যেন হঠা ৎ মাছের মড়ক লাগায় নদীতল ছেয়ে গেছে মরা মাছে, না, কোথাও পানি দেখা যাচ্ছে না লাশ আর লাশ, আর সেসব মাছ নয়, মানুষ, ঢাকার সবগুলো পুলিশ স্টেশনে টেবিলের ওপরে উপুড় হয়ে আছে বাঙালি ডিউটি অফিসারের গুলি খাওয়া মৃতদেহ, দমকল বাহিনীর অফিসে ইউনিফর্ম পরা দমকলকর্মীরা শুয়ে আছে, বসে আছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে দেয়ালে আটকে আছে লাশ হয়ে, ঢাকার সবগুলো বাজারে আগুন দেওয়া—পাতার পর পাতা শুধু এই পৈশাচিকতার, এই আগুনের, লাশের, হত্যার, আর্তনাদের আর মানুষ মারার আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়া সৈনিকের অট্টহাসির, আর মদের গেলাস নিয়ে মাতাল কণ্ঠে সাবাস সাবাস আরো খুন আরো আগুন আরো রেইপ বলে জেনারেলদের চি ৎ কারে ফেটে পড়ার বর্ণনা লেখা যাবে, শত পৃষ্ঠা, সহস্র পৃষ্ঠা, নিযুত পৃষ্ঠা, তবু বর্ণনা শেষ হবে না, তবু ওই বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র আর ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। কেই-বা সব দেখেছে একেবারে, যে দেখেছে রাজারবাগে হামলা, তার কাছে ওই তো নরক, যে দেখেছে ইপিআরে হামলা, এক জীবনে সে আর কোনো দিনও স্বাভাবিক হতে পারবে না, যে অধ্যাপক ভিডিও করেছেন জগন্নাথ হলের মাঠে সারিবদ্ধ ছাত্রদের গুলি করে মেরে ফেলার দৃশ্য, তিনিও তো ঘটনার সামান্য অংশই চিত্রায়িত করতে পেরেছেন মাত্র, যে সায়মন ড্রিং বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার এড়িয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের রান্নাঘর দিয়ে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ পাঠিয়েছিলেন ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ, সাম উইটনেস অ্যাকাউন্টস, হাউ ড্যাক্কা পেইড ফর ইউনাইটেড পাকিস্তান’, তিনি নরকের বর্ণনার সামান্যই দিতে পেরেছিলেন।

পাঠকের হয়তো মনে পড়বে, জীবন আমার বোন উপন্যাসে মাহমুদুল হকও প্রায় এমন রীতি অবলম্বন করেছিলেন কিন্তু তাতে আনিসুল হকের মৌলিকতা বা রচনার শ্রীর কোনো পার্থক্য হয় না।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস হিসেবে এবং মাকে নিয়ে লেখা উপন্যাস হিসেবে আনিসুল হকের মা যে-কোনো সময়ের একটি প্রধান উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করবে বলে আমার মনে হয়।

লেখাটি আনিসুল হক এর ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top